২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০

‘আর যেন কোনো মায়ের কোল খালি না হয়’

নিহত সুমনের পরিবার  © সংগৃহীত

গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন ঘটে। ওই দিন ঢাকার অদূরে আশুলিয়া থানার প্রধান ফটকের সামনে মারমুখী পুলিশ বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে যেসব ছাত্র শহিদ হয়েছেন, তাদের লাশের স্তূপে পুলিশ আগুন ধরিয়ে দেয়। এই খবর শুনে শত শত মানুষ লাশ উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সুমন ইসলামও বসে থাকেননি। বন্ধুকে নিয়ে লাশ উদ্ধারে যান। কিন্তু অপরদিক থেকে পুলিশ গুলি করতে শুরু করে। সে গুলি এসে লাগে সুমনের মাথায়। শহিদ হন তিনি।

শহিদ সুমন ইসলাম (২১) পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়নের আমিন নগর এলাকার হামিদ আলীর ছেলে। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট ছিলেন।

সেদিন সঙ্গে থাকা সুমনের বন্ধু সোলেমান ইসলাম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘লাশ পোড়ানোর মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক ঘটনা শুনে আমরা দুজনে চলে যাই আশুলিয়া থানার প্রধান ফটকের সামনে। সে সময় পুলিশ আমাদের দিকে বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়ে। আমি দৌড়ে পালাতে পারলেও আমার বন্ধু সুমন পালাতে পারেনি। গুলি লাগে তার গায়ে। সে সেখানেই পড়ে যায়। পরে এসে আমি তার খোঁজ করি। কিন্তু পাইনি। মোবাইলে ভিডিও দেখে জানতে পারি, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাকে সেনাবাহিনীর গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়েছে। তার লাশ ৭ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল থেকে উদ্ধার করা হয়।’

সোলাইমান আরও বলেন, লাশ পাওয়ার পর দেখা যায় মাথায় গুলির ক্ষতচিহ্ন। শরীরে রাবার বুলেটের অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন। ৮ আগস্ট গ্রামের বাড়িতে এনে দাফন করা হয় সুমন ইসলামের লাশ।

পরিবারের সূত্রে জানা গেছে, সুমন ইসলাম পঞ্চগড়ের সাকোয়া ফাজিল মাদ্রাসায় প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। সুমনের বাবা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। তাই সুমন অভাবের সংসারের হাল ধরতে ও পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে ঢাকায় ইপিজেডে কাজ নিয়েছিলেন তিন বছর আগে। সংসারের সব দায়িত্ব ছিল সুমনের। একমাত্র কর্মক্ষম সদস্যকে হারিয়ে পরিবারটি এখন দিশেহারা।

সম্প্রতি নিহত সুমন ইসলামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বৃদ্ধ বাবা হামিদ আলী ও মা কাজলী বেগম। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম সন্তানকে হারিয়ে নির্বাক তারা। নিজেদের ভিটেবাড়ির ৪ শতাংশ জমি ছাড়া আর কোনো জায়গাজমি নেই তাদের। এই বৃদ্ধ বয়সে কীভাবে সংসার চলবে, কপালে পড়েছে সেই চিন্তার ভাঁজ।

সুমনের বাবা হামিদ আলী বলেন, ‘আমার ছেলে অভাবের সংসারের হাল ধরতে ঢাকায় গেছে চাকরি করতে। আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে আমার ছেলে শহিদ হয়েছ। ওই দিন থেকেই আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমার তো চলার মতো আর রাস্তা নাই। কীভাবে চলবো এই বৃদ্ধ বয়সে? সংসার চালানোর কেউ রইল না আর।’

সুমনের মা কাজলী বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘লাশ উদ্ধার করতে গিয়ে নিজেই লাশ হয়ে ফিরলো আমার ছেলে। এ আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। আমার ছেলের জীবনের বিনিময়ে দেশে শান্তি চাই। আর যেন কোনো মায়ের কোল খালি না হয়, এই আমাদের চাওয়া।’