সপ্তাহের ব্যবধানে দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীসহ ৭ তরুণ-তরুণীর মৃত্যু, হত্যাকাণ্ড নাকি দুর্ঘটনা?
গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীসহ ৭ তরুণ-তরুণীর মৃত্যু হয়েছে। এসব ঘটনা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড নাকি নিছক দুর্ঘটনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সংশ্লিষ্ট মহলে। কেননা এরমধ্যে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেওয়া কয়েকজনও রয়েছে। তাছাড়া রয়েছে দুটি ছাত্রসংগঠনের তিনজন নেতাকর্মী।
এসব ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিবৃতি দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে। এতে তারা এই ঘটনার উদ্বেগ প্রকাশ করার পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহবান জানিয়েছে।
সর্বশেষ আজ বুধবার সকালে চট্টগ্রামে মহানগরীর একটি হাসপাতালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া জসিম উদ্দিন নামে এক যুবক চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। এর আগে গতকাল মঙ্গলবার রাত ৯টায় তাকে ছুরিকাঘাত করে দুর্বৃত্তরা।
জসিম উদ্দিনকে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কর্মী হিসেবে দাবি করে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সংসদ আজ এক বিবৃতিতে বলেছে, তিনি ছাত্রদলের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করতে জসিম বীরোচিত ভূমিকা পালন করে। ছাত্রদল শহীদ জসিম উদ্দিনের খুনের ঘটনায় গভীরভাবে শোকাহত ও উদ্বিগ্ন।
জানা যায়, চট্টগ্রামের আনন্দ বাজার সিটি কর্পোরেশনের ময়লার ডিপো এলাকায় জসিমের বাসা। ডিপোতে ফেলা নষ্ট ভাতসহ বিভিন্ন উচ্ছিষ্ট সংগ্রহ করে ব্যবসা করতেন তিনি। মূলত সেই ব্যবসা দখলে নিতেই দুষ্কৃতকারীরা পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে জানিয়েছে স্বজন ও স্থানীয়রা। অন্যদিকে পুলিশ জানিয়েছে, নগরের ময়লার ডিপোর উচ্ছিষ্ট সংগ্রহ করে ব্যবসা সংক্রান্ত দখল ও বিরোধের জের ধরে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। আসামিদের ধরতে অভিযান চলছে বলেও জানানো হয়েছে।
আরও পড়ুন: ছিনতাইকারীর হাতে ৩ দিনে দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মৃত্যু, নেপথ্যে কী?
এদিকে, গতকাল মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান শেষে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে দুই তরুণ নিহত হয়েছেন। উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের মল্লিকপুর বাজারে এ ঘটনা ঘটেছে। নিহত দুজন হলেন ফতেপুর ইউনিয়নের এজাবুল হকের ছেলে মাসুদ রানা (২২) ও আবদুর রহিমের ছেলে রায়হান (১৫)।
স্থানীয় সূত্র জানা যায়, নিহত মাসুদ রানা নাচোল উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সম্প্রতি ফেসবুকে এক ভিডিওতে তাকে জয় বাংলা লিখতে দেখা যায়। পুলিশ বলছে, রাজনৈতিক বিরোধের জের ধরে এই হামলা ও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
নাচোর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম বলেন, পূর্ববিরোধের জেরে দুই পক্ষের মধ্যে এ ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুজনকে আটক করেছে। এ ঘটনায় মামলার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।
নিহত দুইজন নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মী দাবি করে রক্তের শপথ নেয়ার ঘোষণা করছে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সংসদ। আজ বুধবার এক বিবৃতিতে বলা হয়, ছাত্রলীগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ইলেকট্রনিক বিভাগের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা এবং নাচোল উপজেলা শাখান কর্মী রায়হান গতকাল রাতে নাচোল উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের মল্লিকপুর বাজারে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেছে।
গতকাল মঙ্গলবার কলেজছাত্রী সুজানার পর নারায়ণগঞ্জের পূর্বাঞ্চলে একই লেক থেকে তার বন্ধু শাহিনুর রহমান কাব্যের লাশও আজ বুধবার উদ্ধার করা হয়েছে। সুজানার মরদেহ উদ্ধারের ১৫ ঘণ্টা পর আজ বুধবার সকালে ১৬ বছর বয়সী কাব্যের লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল।
নিহত শাহিনুর রহমান কাব্য কাফরুল থানার কচুক্ষেত বউ বাজার এলাকার হারুনুর রশিদের ছেলে। সে রাজধানীর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।
নারায়ণগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার মেহেদী ইসলাম জানান, মঙ্গলবার সকালে পূর্বাচল ২ নম্বর সেক্টরে কাঞ্চন-কুড়িল বিশ্বরোড সড়কের বউরাটেক এলাকার ৪ নম্বর সেতুর নিচে লেক থেকে পুলিশ সুজানা নামের এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করে তার স্বজনদের কাছ থেকে জানতে পারি সুজানার সঙ্গে কাব্য নামে আরেক কিশোর নিখোঁজ রয়েছে। পরে এদিন সকালে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দলের সহায়তায় পুলিশ লেকের পানির নিচ থেকে মোটরসাইকেলসহ কাব্যের লাশ উদ্ধার করে।
জানা যায়, মঙ্গলবার সকাল ৮টার দিকে কুড়িল-কাঞ্চন আঞ্চলিক সড়কের পাশে পূর্বাচলের ২ নম্বর সেক্টরের বউরারটেক এলাকায় লেকটিতে ঢাকার ভাসানটেক কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সুজানার মরদেহটি ভাসতে দেখেন স্থানীয় লোকজন। পরে তারা পুলিশে খবর দেন। এ সময় লেকের পাশ থেকে একটি হেলমেট ও ব্যাগ উদ্ধার করা হয়।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার সকাল ৬টার দিকে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (এআইইউবি) এর কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র নারায়ণঞ্জের বাসা থেকে বের হয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য। যাওয়ার পথে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে আহত হয়েছিলেন। ঘটনার দুই দিনর পর গতকাল শনিবার (১৪ ডিসেম্বর) রাত ১১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
আরও পড়ুন: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ
সীমান্তের বাবা আলম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে সীমান্তকে ছুরিকাঘাত করা হয়। স্থানীয়রা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান। তার শরীরে বেশ কয়েকটি জখম ছিল।
একইদিন ভোরে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষার্থী তাজবির হোসেন শিহানকে (২৬) কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তিনি উপজেলার মৌচাক জামতলা এলাকার তানভির হোসেন নান্নু মিয়ার ছেলে। চাকরি করতেন উত্তরার একটি কল সেন্টারে।
তাকে পরিকল্পিতভাবে কুপিয়ে হত্যা অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। গত রবিবার ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের সামনে এ কর্মসূচি পালন করেছেন তারা।
এ সময় তারা চার দফা দাবি তুলে ধরেন। দাবির মধ্যে রয়েছে- বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে একটি বিবৃতি দিতে হবে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে শিহানকে একটি ফিচার করতে হবে; পুলিশের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দিতে হবে; ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তার করে বিচার শুরু হবে এবং যতক্ষণ তাদের গ্রেপ্তার না করা হবে, ততক্ষণ ফেসবুক প্রোফাইলে তার ছবি ও মৌন প্রতিবাদ চলবে।
দুই শিক্ষার্থী হত্যার প্রতিবাদে আজ বুধবার ঢাকার রামপুরা এলাকা ও সাভারের রিরুলিয়ায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে শিক্ষার্থীরা। এর আগে গতকাল মঙ্গলবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। তারা জানান, এই দু’জনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশ নিয়েছে। তাই তাদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হতে পারে।
সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল কাদের বলেন, আমরা দেখেছি নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ধানমন্ডি ৩২-সহ বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালাচ্ছে। কিন্তু প্রশাসন নির্বিকার। আমরা এখানে কাঁদতে আসি নাই। আমরা এখানে ফাঁসির দাবিতে এসেছি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু বকর মজুমদার বলেন, গত ১২ ডিসেম্বর, ১৪ ডিসেম্বর ৩ জন ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা তাদেরকে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী মনে করছি না, আমরা তাদেরকে বিপ্লবী মনে করছি। আমাদের ভয় পাওয়ানোর কোনো সুযোগ নেই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক তাহমিদ আল মুদাসসির চৌধুরী, এই নতুন বাংলাদেশে কেন বিপ্লবীদের রক্ত ঝরে তার জবাব দিতে হবে প্রশাসন দিতে হবে। আমাদের বিপ্লবীদের রক্ষা এই সরকারকে করতে হবে। নাহলে এই সরকারের বিরুদ্ধেই আমরা আন্দোলন করব।