আবার ঢাকায় ফিরলেন পিটার হাস
বাংলাদেশে প্রায় তিন বছর দায়িত্ব পালন করে গত জুলাইয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য সাবেক রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। এর দুই মাসের মাথায় তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। পরে তিন দিনের মাথায় যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি জ্বালানি প্রতিষ্ঠান অ্যাকসিলারেট এনার্জিতে। এই কাজে আবারও বাংলাদেশে ফিরেছেন প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশ-প্রধান হয়ে।
বাংলাদেশে দুটি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত অ্যাকসিলারেট এনার্জি। এর একটির মালিক তারা নিজে। অন্যটি সামিট গ্রুপের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া। এ ছাড়া ২০২৬ সালের শুরু থেকে এই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এলএনজি কেনার চুক্তিও রয়েছে সরকারের। এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে আজকের পত্রিকা।
মার্কিন সদ্য সাবেক এই কূটনীতিকের এভাবে বেসরকারি জ্বালানি প্রতিষ্ঠানের হয়ে বাংলাদেশে ফেরা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিটার হাস জ্বালানি বিশেষজ্ঞ নন। তা সত্ত্বেও তাকে জ্বালানি প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ প্রধান করে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এর পেছনে সাবেক এই রাষ্ট্রদূতের শেষ কর্মস্থলে তৈরি হওয়া প্রভাব কাজে লাগানোর কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়াও পিটার হাসকে নিয়োগের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আইনেরও ব্যত্যয় করা হয়ে থাকতে পারে। যদিও ‘রিভলভিং ডোর’ নামের আইনটির শর্ত যুক্তরাষ্ট্রের একেক অঙ্গরাজ্যের ক্ষেত্রে একেক রকম। এই আইনের শর্ত হলো, মার্কিন কোনো সরকারি কর্মকর্তা অথবা আইনপ্রণেতাকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার পর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের লবিস্ট হিসেবে নিয়োগ পেতে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আইনের ব্যত্যয় ঘটানোয় গত বছর সাবেক এক মার্কিন কূটনীতিককে বড় অঙ্কের জরিমানা গুনতে হয়েছে।
পিটার হাসের এভাবে সরকারি চাকরি ছাড়ার পরপরই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার বিষয়ে জানতে যুক্তরাষ্ট্রের হোম স্টেট বিভাগের এথিকাল কমিটির কাছে গত ২ নভেম্বর ই-মেইল করা হয়েছিল। তবে এই প্রতিবেদন প্রকাশের আগ পর্যন্ত তারা কোনো জবাব দেয়নি। অ্যাকসিলারেট এনার্জির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একাধিক ব্যক্তির সঙ্গেও ই-মেইলে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারাও কোনো জবাব দেননি।
পিটার হাস ১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ওয়েসলিয়ান ইউনিভার্সিটি থেকে জার্মান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে পিটার হাস মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে অর্থনীতি ও ব্যবসাবিষয়ক ভারপ্রাপ্ত সহকারী সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন শেষে পিটার হাস গত ২২ জুলাই দিবাগত মধ্যরাতে ঢাকা ত্যাগ করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তিনি গত ২৭ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অবসর নেন। এর তিন দিনের মাথায় ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি অ্যাকসিলারেট এনার্জির ওয়াশিংটন ডিসি অফিসে যোগদান করেন।
পিটার হাসের নিয়োগ প্রসঙ্গে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অ্যাকসিলারেট এনার্জির প্রেসিডেন্ট ও সিইও স্টিভেন কোবোস বলেন, ‘কর্মজীবনে তিনি মার্কিনদের ব্যবসা ও বাণিজ্যিক স্বার্থের জন্য অক্লান্ত কাজ করেছেন। পিটার ভূরাজনীতি ও বাজার বোঝেন।’
অ্যাকসিলারেট এনার্জির হয়ে পিটার হাস সম্প্রতি ঢাকায় আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) একটি গোলটেবিল আলোচনায়ও যোগ দেন। বিদেশি বিনিয়োগের ওই আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। আলোচনা অনুষ্ঠানে আরেক অতিথি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তেল-গ্যাস উন্নয়ন অনুসন্ধান প্রতিষ্ঠান শেভরনের প্রেসিডেন্ট এরিক ওয়াকারও।
এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বলেন, একটি দেশের রাষ্ট্রদূত অনেক বড় পদ। তিনি সেখান থেকে অবসর নিয়ে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে বেসরকারি একটি কোম্পানির হয়ে তার পুরোনো কর্মক্ষেত্রে ফিরেছেন। সাধারণ কোনো কারণে এমনটি হয়নি।
বাংলাদেশে অ্যাকসিলারেট এনার্জির কার্যক্রম
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, অ্যাকসিলারেট এনার্জি ২০১৮ সালের মে মাসে বাংলাদেশে সাগরে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল সেবা শুরু করে। এই কাজটি তারা পায় বিনা দরপত্রে বিশেষ আইনে। সেবা ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে অ্যাকসিলারেট এনার্জিকে প্রতিবছর প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা দেওয়ার কথা রয়েছে সরকারের। সে হিসাবে ১৫ বছরে এ বাবদ দিতে হবে ৪৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। ১৩ বছরের পুরোনো এলএনজি জাহাজ দিয়ে এই সেবা শুরু করায় শুরুতেই প্রশ্ন উঠেছিল। অভিযোগ উঠেছিল, জাহাজ না কিনে ভাড়া নিয়ে মূলত সরকার বিদেশি কোম্পানিকে বিশেষ সেবা দিচ্ছে।
নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, এলএনজি টার্মিনাল ব্যবসায় অ্যাকসিলারেট এনার্জি বাংলাদেশ থেকে ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তিন বছরে ফিক্সড কস্ট (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) পেয়েছে ২৫ কোটি ৯৬ লাখ ৪৯ হাজার ডলার।
পেট্রোবাংলা সূত্র বলেছে, ২০১৭ সালে সামিট গ্রুপ বিনা দরপত্রে এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের অনুমতি পায়। এরপর তারা টার্মিনালটি অ্যাকসিলারেট এনার্জিকে দিয়ে দেয়। ২০১৯ সালের এপ্রিলে এই টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ শুরু করে সামিট। প্রতিবছর সামিট গ্রুপ সরকারের কাছ থেকে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা এলএনজির টার্মিনাল ভাড়া বাবদ নেয়। এর একটি অংশ তারা অ্যাকসিলারেট এনার্জিকে দেয় জাহাজভাড়ার অংশ হিসেবে। এ ছাড়া সরকারের সঙ্গে অ্যাকসিলারেট এনার্জির থেকে ১৫ বছর মেয়াদে এলএনজি আমদানির চুক্তিও রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে তারা এলএনজি সরবরাহ করবে। অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের আমলে এলএনজি টার্মিনাল দুটির বিষয়ে হওয়া সমঝোতা স্মারক বাতিল করেছে। সরকার টার্মিনাল দুটি দরপত্রের মাধ্যমে দিতে চায়। এই দরপত্রে অ্যাকসিলারেট এনার্জিও অংশ নেবে বলে জানা গেছে।
মার্কিন আইনের ব্যত্যয় নিয়ে প্রশ্ন
যুক্তরাষ্ট্রে ‘রিভলভিং ডোর’ নামে একটা আইন আছে। এই আইন অনুযায়ী, দেশটির কোনো আইনপ্রণেতা কিংবা সরকারি কর্মকর্তা দায়িত্ব থেকে অবসরের ছয় মাস থেকে দুই বছরের মধ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের লবিস্ট হিসেবে যুক্ত হতে পারবেন না। এই সময়কে আইনে ‘কুলিং অব পিরিয়ড’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। মার্কিন সরকারের হয়ে কাজের সময় তৈরি হওয়া প্রভাবের অপব্যবহার ঠেকাতে ১৮৭২ সালে আইনটি করা হয়। বেশির ভাগ অঙ্গরাজ্যেই এই আইনটি আছে। যেসব অঙ্গরাজ্যে আইনটি নেই, সেসব অঙ্গরাজ্যে ভিন্ন কোনো আইনের মাধ্যমে বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে।
অঙ্গরাজ্যভেদে আইনটির ‘কুলিং অব পিরিয়ড’ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ওয়াশিংটনে বর্তমানে এই আইনটি নেই। ভিন্ন কোনো আইনে এই অঙ্গরাজ্যে এ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে কি না, সেটিও জানা যায়নি। অবশ্য মার্কিন কংগ্রেসে ২০১৯ সালে ফেডারেল সরকারের জন্য প্রণীত এক আইনে সাবেক সিনেটর, প্রতিনিধি পরিষদ সদস্য অথবা সিনেট কিংবা প্রতিনিধি পরিষদে নির্বাচিত কোনো কর্মকর্তার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। সেই আইনে বলা হয়েছে, সাবেক কোনো সিনেটর, সাবেক প্রতিনিধি পরিষদ সদস্য অথবা সিনেট কিংবা প্রতিনিধি পরিষদে কাজ করতে নির্বাচিত হয়েছেন—এমন সাবেক কোনো কর্মকর্তা তাঁর জীবদ্দশায় কংগ্রেসের বর্তমান কোনো সদস্য, কর্মকর্তা বা কর্মী অথবা কোনো আইনসভা কার্যালয়ের কোনো কর্মীর কাছে তদবির করতে পারবেন না। নতুন আইনে সিনেটের সাবেক কর্মকর্তা ও কর্মী, প্রতিনিধি পরিষদ সদস্যদের সাবেক ব্যক্তিগত কর্মী, কংগ্রেসসহ সব আইনসভার কমিটির সাবেক কর্মীদের ক্ষেত্রে ‘কুলিং অব পিরিয়ড’ এক বছর থেকে বাড়িয়ে ছয় বছর করা হয়েছে।
পিটার হাসের নিয়োগে এই আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো দেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিয়োগের ক্ষেত্রে মনোনয়ন দেন প্রেসিডেন্ট। আর সে মনোনয়ন চূড়ান্ত হয় সিনেট শুনানিতে।
এর আগে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া রাজ্যের একটি আদালত ‘রিভলভলিং ডোর আইন’ লঙ্ঘন করায় সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত রিচার্ড গুস্তাভ ওলসন জুনিয়রকে প্রায় ৯৪ হাজার ডলার জরিমানা করেন। তিনি ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং ২০১৫ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত আফগানিস্তান ও পাকিস্তান-বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অবসরের পর তিনি মাসিক ২০ হাজার ডলার ফিতে কাতার সরকারের জন্য কাজ করেন। এ সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন।