০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৪৮

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আগ্রহ কমছে ছাত্র সংগঠনগুলোর?

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা  © সংগৃহীত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের সাড়া উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে। সংগঠনটির নেতাদের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগে তাদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে ছাত্র সংগঠনগুলোর।

অভিযোগ আছে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ৮ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করে। ১২ আগস্ট এই কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভায় ৩৪টি ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় একটি ফ্যাসিবাদবিরোধী জোট গঠনের সিদ্ধান্ত হলেও, অভ্যুত্থানের প্রায় চার মাসেও সেটি বাস্তবায়ন হয়নি।

আরও অভিযোগ রয়েছে, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কাজে শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করার যে প্রতিজ্ঞা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার করেছে, সেটিও বাস্তবায়ন হয়নি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে। রাষ্ট্রীয় যেকোনো কাজে শুধু তারাই থাকে। অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব একেবারেই শূন্যের পর্যায়ে।

জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে যে অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় ঐক্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা এখন একটি পক্ষের সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে।─ নাছির উদ্দিন নাছির, সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় ছাত্রদল

সর্বশেষ ৩ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ছাত্রদের সাক্ষাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মী ছাড়া অন্য কোনো ছাত্র সংগঠনের উপস্থিতি ছিল না। নেতাকর্মীদের অনুপস্থিতি তাদের মধ্যে আরও দূরত্ব তৈরি করেছে।

এই পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয় গতকাল বুধবার (৪ ডিসেম্বর) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে।

দপ্তর সেল সম্পাদক জাহিদ আহসানের সই করা এই বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বুধবারের সভায় রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন কিংবা অভ্যুত্থানকারী সংগঠন হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। বরং গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট বজায় রাখতে সরকারের ভূমিকার ব্যাপারে পরামর্শ নেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। জাতীয় ঐকমত্য গঠনের যে ডাক প্রধান উপদেষ্টা দিয়েছেন, গতকালের মতবিনিময় সভায় তার কোনো প্রয়াস ছিল না।’

তবে এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তির ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান বলেন, ‘তাহলে তো পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হলো। গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা কি কেবল ওই কয়জনকেই চেনেন? সাবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এখানে সবাই বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে?’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকার যখন যে ক্রাইটেরিয়াতেই ডাকে না কেন, তাতে বৈষম্যবিরোধী সমন্বয়ক এবং নাগরিক কমিটির বাইরের কাউকে দেখা যায় না। আবার নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব মঙ্গলবার ছাত্র প্রতিনিধি এবং বুধবার  রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কার কার পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন, তা প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর কিসের ভিত্তিতে ঠিক করে?’

লক্ষণীয় বিষয় হলো, লিয়াজোঁ কমিটির প্রথম সভায় ৩৪টি ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এতে বাম ও মধ্যমপন্থী সংগঠনগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ একাধিক ধর্মভিত্তিক ছাত্র সংগঠন অংশ নিয়েছে।

তারা নিজেরাই রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন কি না, সেটা স্বীকৃতি দেয়নি। তাদের নিজেদের মধ্য থেকেই অনেকেই প্রতিবাদ করেছেন যে শুধু গুটি কয়েক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরাই কি ছাত্র প্রতিনিধি?─ মো. সানাউল্লাহ, আহ্বায়ক, বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দ্বিতীয় সভা হয় গত ২৫ নভেম্বর। সেখানে উপস্থিত ছিল মাত্র ১৯টি ছাত্র সংগঠন। তাদের সর্বশেষ সভা হয় বুধবার (৪ ডিসেম্বর) রাতে। এই সভায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, বামপন্ত্রী সংগঠনগুলোসহ বেশ কিছু ছাত্র সংগঠন অংশ নেয়নি।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কার প্রকল্প, শহীদদের নিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগসহ নানা কার্যক্রমে ছাত্রদের যুক্ত করার কথা বলেছে। কিন্তু আমরা সব ক্ষেত্রে দেখেছি কেবল একটি সুনির্দিষ্ট পক্ষকেই সব কার্যক্রমে যুক্ত করা হচ্ছে। অন্য কোনো সংগঠনের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনাও করা হয়নি।

তিনি আরও বলেন, গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা  ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আলোচনার নামে কেবল কয়েকজন সমন্বয়কের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। এতে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে যে অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় ঐক্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা এখন একটি পক্ষের সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ছাত্রদের মধ্যে জাতীয় ঐক্যের বিষয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সভায় উপস্থিত অন্য এক ছাত্র সংগঠনের শীর্ষ নেতা বলেন, বুধবার রাতের সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হন। তারা এখনো জানেন না তাদের সংগঠনটি কাদের নিয়ে। তারা কি কোনো রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন? এই প্রশ্নের জবাবও তারা দিতে পারেননি। যদি তারা ছাত্র সংগঠন না হয়ে থাকে, তাহলে তাদের ডাকে আমরা আসবো কেন? যদি তারা রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন হয়ে থাকে, তবে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাকর্মীরা কেন ছিল? তারা তো রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন না।

এই নেতা আরও বলেন, সফলভাবে ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন নিশ্চিত করার পর এই প্ল্যাটফর্মের আর প্রয়োজনই ছিল না। জাতীয় নাগরিক কমিটি ঠিক আছে। কারণ তারা একটি রাজনৈতিক দল করবে। দেশে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আর প্রয়োজন নেই। এখন তারা ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেয়ে বিভাজন বেশি তৈরি করছে।

সব ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনকে ক্রমানুযায়ী ডাকবেন। আমরা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন না। আমরা গণ-অভ্যুত্থানের প্ল্যাটফর্ম।─ হাসনাত আব্দুল্লাহ, আহ্বায়ক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক মো. সানাউল্লাহ বলেন, গত পরশু প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তারা। সেখানে অন্য কোনো ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধি ছিল না। তারা নিজেরাই রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন কি না, সেটা স্বীকৃতি দেয়নি। তাদের নিজেদের মধ্য থেকেই অনেকেই প্রতিবাদ করেছেন যে শুধু গুটি কয়েক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরাই কি ছাত্র প্রতিনিধি? জুলাই আন্দোলনে সব ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করেছে। এই আন্দোলনে ছাত্র অধিকার পরিষদের ভূমিকা অনেক। প্রধান উপদেষ্টার সভায় কেন আমাদের ডাকা হয়নি, সে জন্য আমরা প্রতিবাদস্বরূপ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানে সাড়া দিইনি।

তিনি যোগ করেন, যদি ভবিষ্যতে একত্র করে কাজ করার ইচ্ছে থাকে, তবে আমরাও উপস্থিত থাকবো।

বুধবারের সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে বক্তব্য রাখেন আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ, সদস্য সচিব আরিফ সোহেল এবং মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসুদ।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারে হাসনাত আব্দুল্লাহ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এখানে কোনো ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনকে ডাকেনি। গণ-অভ্যুত্থানের যে প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, সেটাকে ডেকেছিলেন। সব ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনকে ক্রমানুযায়ী ডাকবেন বলে আমরা জানি। ছাত্র সংগঠন, সুশীল সমাজ সবাইকেই ডাকবেন। ছাত্র সংগঠনগুলোর মূল সংগঠন কিন্তু প্রতিনিয়ত সরকারের সঙ্গে বসছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন না। আমরা গণ-অভ্যুত্থানের প্ল্যাটফর্ম।