৫ আগস্ট রাতে বঙ্গভবনে ৩ শিক্ষার্থীকে কে নিয়েছিলেন, জানালেন ফিরোজ আহমেদ
ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট রাতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিতে বঙ্গভবনে রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে এসেছিলেন ৩ শিক্ষার্থী প্রতিনিধি। ৩ শিক্ষার্থীকে কী উদ্দেশ্যে কে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন তা নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা চলছে কিছুদিন ধরেই। সেদিন রাতে বঙ্গভবনের আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন সংবিধান সংস্কার কমিটির সদস্য, লেখক ও গবেষক ফিরোজ আহমেদ। সেদিন রাতের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে খোলামেলা বলেছেন এই লেখক।
রবিবার (১ ডিসেম্বর) ফিরোজ আহমেদ তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, ‘৫ আগস্ট রাতে রাষ্ট্রপতির সাথে বৈঠকে সত্যিই তিনজন শিক্ষার্থী উপস্থিত হয়েছিলেন, নিজেদেরকে তারা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে দাবিও করেছিলেন এবং তারা ওখানকার বৈঠকে বাকিদের সাথে বসেওছিলেন। এই তিনজনের সঙ্গে আসিফ নজরুলের সম্পর্ক নিয়েই এখন কথা উঠেছে।’
অনেকে বলছেন, অধ্যাপক আসিফ নজরুল ৩ শিক্ষার্থী প্রতিনিধিকে বঙ্গভবনে নিয়ে গিয়েছিলেন। আবার অনেকে বলছেন জোনায়েদ সাকিই ওই ৩ শিক্ষার্থী প্রতিনিধিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। ফিরোজ আহমেদ লিখেছেন, ‘ঘটনাক্রমে আমি পুরো দিনটা আসিফ নজরুল এবং জোনায়েদ সাকির সাথে ছিলাম, বিশেষ করে আসিফ নজরুলের সাথে একই গাড়িতে সেনানিবাস থেকে বঙ্গভবনে গিয়েছিলাম। শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে এই তিন শিক্ষার্থীকে বঙ্গভবনে হাজির করাবার কোন চেষ্টা বা তৎপরতা আসিফ নজরুল অন্তত এই সময়টুকুতে, দুপুর থেকে রাতের মাঝে দেখাননি। বরং তিনি এবং জোনায়েদ সাকি দুজনেই যাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা বিশেষভাবে করছিলেন গোটা দিন জুড়ে, তারা এখন উপদেষ্টা পরিষদেই আছেন।’
সেদিন রাতে ঘটনা বর্ণনা করে ফিরোজ আহমেদ আরও লিখেছেন, ‘জোনায়েদ সাকি সেখানে গিয়েছিলেন এই সিদ্ধান্তটা জানাতে যে, জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য কোন একটা অন্তবর্তীকালীন একটা সরকার ছাড়া কোন সেনা সরকার কিংবা কার্যত সেনাসমর্থিত সরকার মানুষ মেনে নেবে না। কাজেই সকল পক্ষের সাথে আলাপের ভিত্তিতেই একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এবং সেটা ক্যানটনমেন্টে না।’
তিনি লিখেছেন, ‘বিশেষভাবে যেটা জানা জরুরি, আসিফ নজরুলের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ওই রাতেই কারাবন্দি আখতারকে বিশেষ ব্যবস্থায় কারাগার থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসার বন্দোবস্ত করা হয়। আলোচিত তিন শিক্ষার্থীকে নেতা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চাইলে আখতারকে মুক্ত করার উদ্যোগ তিনি নিতেন না। বরং আখতারের সাথে আন্দোলনকারী নেতৃত্বের বিশেষ যোগাযোগ রয়েছে, এটা উল্লেখ করেই তিনি কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ তৈরি করেন।’
সেদিন ৩ শিক্ষার্থী প্রতিনিধির ভূমিকা প্রসঙ্গে ফিরোজ আহমেদ লিখেছেন, ‘এখানে আরও একটা কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা রয়েছে। এই তিন শিক্ষার্থী তখন বেশ উত্তেজিত ছিলেন। আমাদের সাথে আলাপচারিতার ক্ষেত্রে তাদের শরীরী ভাষাতেও সেটা পরিষ্কার ছিল। তারা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হলে, বা সমন্বয়ক হলে তাদের দাবি কী, কর্মসূচি কী, বাকিদের প্রতি তাদের বক্তব্য কী, সেটা তারা পরিষ্কার করে বলছিলেন না। পরিস্থিতির কারণেই সেটা আমাদের কাছে ততটা অস্বাভাবিক মনে হয়নি। আমি ব্যক্তিগতভাবে ভেবেছিলাম যে, আন্দোলনের চাপের ফল এবং উদ্বেগ ও দায়িত্ববোধ থেকে এই উত্তেজনা ও অস্থিরতা।’
৩ শিক্ষার্থী সম্পর্কে তিনি আরও লিখছেন, ‘সেদিন আমাদের সাথে থাকা আইনজীবী, গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা হাসনাত কাইয়ূম ভাইয়ের কাছে একটা তথ্য জানলাম। কাইয়ূম ভাই ক্যানটনমেন্টে যাননি, আরও কিছু নেতৃবৃন্দের মতই তিনি সরাসরি বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন। তার সেই তথ্যটিই হলো আজকের প্রসঙ্গের মূল বিষয়। কাইয়ূম ভাই জানালেন: এই শিক্ষার্থী তিনজন সক্রিয়ভাবেই আন্দোলনে ছিলেন। কিন্তু তারা সমন্বয়কদের মাঝেকার কেউ না। তবে তারা আগের বারের, অর্থাৎ ২০১৮ সালের কোটা বিরোধী আন্দোলনের কোন কোন নেতার সাথে সাথে সম্পৃক্ত। আগেকার আর বর্তমান কোটা বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বের মাঝে কিছু সম্পর্কের টানাপড়েন আছে। ফলে, এদেরকে আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে চিত্রিত করা, বা তাদেরকে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে দেখানো হচ্ছে এমনটা মনে হলে আসল সমন্বয়করা সঙ্গতকারণেই পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে সংশয়ে পরতে পারেন, কোন একটা ষড়যন্ত্র এখানে তাদের অনুপস্থিতিতে হচ্ছে বলেও ভাবতে পারেন। এটা বড় রকমের ভুল বোঝাবুঝিরও সৃষ্টি করতে পারে।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘হাসনাত কাইয়ুমের তথ্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করে তথ্যটি আমি তাৎক্ষণিকভাবে আসিফ নজরুল ভাইকে জানাই। তিনি এবার আবারও সমন্বয়কদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। সাকি ভাইও চেষ্টা করেন। যোগাযোগ নানা কারণেই কঠিন হয়ে উঠছিল, কিন্তু চেষ্টার কোন ত্রুটি আদতেই ছিল না। তাদের চেনেন এমন প্রায় সকলকেই আমরা অনুরোধ করি সমন্বয়কদের সাথে যোগাযোগ করতে। কিন্তু ওই তিন শিক্ষার্থীর সাথে সকলেই অত্যন্ত সৌজন্য নিয়েই কথা বলেছেন। প্রতিনিধি হিসেবে তাদের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করা, কিংবা তাদের উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন কেন করা হয়নি, সেই প্রশ্ন আশা করি কেউ তুলবেন না। পরিস্থিতি অত্যন্ত ঘোলাটে ও জটিল ছিল। সকলের কাছেই তখনও বহু তথ্য অজানা। তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে হাসতান কাইয়ূম যা জানতেন, তা হয়তো খুব অল্প কিছু মানুষের জানা ছিল।’
ঘটনার বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি আরও লিখেছেন, ‘তাদের সাথে আসিফ নজরুলের ছবি বিষয়েও বলে রাখা যাক। বঙ্গভবনের বৈঠক শেষে সাংবাদিকরা সকলকেই অনুরোধ করেন পর্যায়ক্রমে কিছু না কিছু বলবার জন্য। ওই তিন শিক্ষার্থীকেও তারা কিছু বলতে অনুরোধ করেন, আসিফ নজরুলকে তারা অনুরোধ করেন তাদের পাশে দাঁড়াতে। কারণটা বোধ করি এই যে, তার ভাবর্মূতিটি ছিল আন্দোলনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত একজন দলনিরপেক্ষ সক্রিয় বুদ্ধিজীবীর। আসিফ নজরুল যেহেতু ততক্ষণে এই উপদল সম্পর্কে কিছুটা অবগত, হয়তো সে কারণেই অনুরোধ না ফেলে খুবই সাধারণীকৃত কিছু কথা সেখানে তিনি এই বিষয়ে বলেন, গণঅভ্যুত্থান বিষয়েই এবং সকলের সাথে আলোচনার ভিত্তিতেই যে সরকার গঠিত হবে, সেই বিষয়ে।’
তিনি লিখেছেন, ‘আমরা যতদূর মনে পড়ে, সাংবাদিকদের সামনে ওই শিক্ষার্থীদের তিনি কোনভাবেই সমন্বয়ক বা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেননি। খুব সম্ভবত, আসিফ নজরুল এর আগে শিক্ষার্থীদের মাঝেকার জটিলতা বিষয়ে ততটা সচেতন ছিলেন না। অন্যদিকে আইনজীবী ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের নেতা হাসনাত কাইয়ূম এই বিষয়ে ভালোভাবেই অবগত ছিলেন। কারণ তার কাছে পুরোনো ও নতুন কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের উভয়পক্ষই বিভিন্ন সময়ে আইনি পরামর্শ, সাহায্য ও নৈতিক সমর্থনের জন্য গিয়েছিলেন। ফলে তিনি এদের অধিকাংশকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন এবং তাদের মাঝেকার সম্ভাব্য মতবিরোধ বিষয়েও তিনি সচেতন ছিলেন।’
আসিফ নজরুলের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘যেটা জরুরি সেটা হলো, হাসনাত কাইয়ূমের বক্তব্য শোনার পর আসিফ নজরুল এই তিনজনকে কোনোভাবেই আর শিক্ষার্থীদের গ্রহণযোগ্য প্রতিনিধি হিসেবে নিসংশয়ভাবে গণ্য করেননি, তেমনভাবে উপস্থাপন করেননি। আর, সেখানে যেহেতু তখনই সরকার গঠন নিয়ে আলাপ হচ্ছিল না, ভাগবাটোয়ারা বা তাদেরকে চাপিয়ে দেয়ার প্রশ্নও আসে না। এখন বরং মনে হচ্ছে, ভাগ্যিস হাসনাত কাইয়ূম উপস্থিত ছিলেন! না হলে আসিফ নজরুল নিজের অজ্ঞাতেই কোন ভুল বাক্য বলে ফেললে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বেশুমার ফলন হতে পারত। এমনকি, তেমন কোন বাক্য যদি তিনি বলেও ফেলতেন পরিচয়ের অভাব হেতু, এই রকম একটা ঘটনায় তাকে ষড়যন্ত্রকারী বা কোন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভূমিকা পালনকারী হিসেবে দেখানোর সামর্থ্য অতি বড় সৃজনশীল কল্পনাশক্তির পক্ষেই সম্ভব। এদের সেখানে উপস্থিত করবার বেলায় তার কোন ভূমিকা, অথবা তাদেরকে আন্দোলনের সমন্বয়ক হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার বা ব্যবহার করার কোন চেষ্টা তার ছিল না।’
ফিরোজ আহমেদ আরও লিখেছেন, ‘অবশেষে সমন্বয়কদের সাথে পূর্ণ যোগাযোগ সম্ভব হয়। সমন্বয়কদের মূল অংশের সাথে আলোচনা করবার জন্য আসিফ নজরুলকে ওই টেলিভিশন কেন্দ্রটিতে নামিয়ে দিয়ে এসে বেশ রাতে আমি ও জোনায়েদ সাকি বাসায় ফিরি। আমাদের আগে নামিয়ে ওই তিন শিক্ষার্থী প্রতিনিধির মাঝে যিনি নারী ছিলেন, তাকেও একই গাড়ি নামিয়ে দেয়, কেননা ঢাকা শহর সেদিন সন্ধ্যাতেই ভীতিকর রকমের শুনশান ছিল। টিভি স্টেশনে আসিফ নজরুল যেয়ে সমন্বয়কদের সাথে আলাপের আগ পর্যন্ত সরকার গঠন নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি, কেবল দুটো বিষয়ে আমাদের বক্তব্য জোর দিয়ে বলা ছাড়া। সেগুলো আগেও বলেছি, ১. সকলের সম্মতি ছাড়া কোন সরকার গঠন হবে না; ২. কোন বাহিনী বা সংস্থার ক্ষমতা গ্রহণ জনগণ মেনে নেবে না।’
অনেনেক বলছেন জোনায়েদ সাকি ৩ শিক্ষার্থীকে বঙ্গভবনে নিয়ে গিয়েছিলেন, এ প্রসঙ্গে ফিরোজ আহমেদ লিখেছেন, ‘কেউ কেউ বলছেন, ওই তিনজন আমাদের কাছে অপরিচিত মুখকে জোনায়েদ সাকি বঙ্গভবনে নিয়ে গিয়েছেন! এটা হাস্যকর স্রেফ এই বিবেচনায় যে, ছাত্র ফেডারেশনের তখনকার একজন নেতা উমামা ফাতেমা একজন অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক, আন্দোলনের পরিচিত মুখ ছিলেন। কাউকে চাপিয়ে দিতে চাইলে জোনায়েদ সাকি তার বলয়ের এবং গ্রহণযোগ্য, পরিচিত মুখদেরই নেয়ার কথা। এইটুকু ব্যাখ্যাই যথেষ্ট।’