‘তাজা গুলিডা খাইছে আমার বাবায়, ১০ মিনিটও বাঁইচ্যা আছেলে না’
‘তাজা গুলিডা খাইছে আমার বাবায়, দশ মিনিটও বাঁইচ্যা আছেলে না। আমার বাজানরে,আমার পোলারে কুনদিন কষ্ট দেই নাই। হেই পোলায় কত কষ্ট পাইয়া মরল।’ কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ করে এভাবেই বলছিলেন শহিদ সারোয়ার হোসেন শাওনের বাবা মো. জাকির হোসেন। শাওন গত ১৯ জুলাই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের হামলায় নিহত হন।
কান্নাজড়িত কন্ঠে বাসসের প্রতিনিধিকে তিনি বলেন, কত রোইদ বৃষ্টি মাথায় নিয়া কাজ করছি, তাও আমার পোলারে কষ্ট দেই নাই, কষ্ট করাই নাই। ভাবছি রেস্টুরেন্টে ফ্যানের বাতাসে আরাম কইরা কাজডা তাও শিখব। পেডে ভাতে কাজডা শিউক। আমার কওয়ালে নাই পোলার রোজগার। আমার পোলায় গুলি খাইলো।
তিনি আরো বলেন, ‘হাসপাতালের অবস্থা দেইখ্যা আমার কলিজা উল্ডায়া গেছে গা। আমি দেখি হাসপাতালের গেটের সাটার টানে মানুষ ডোহায়। বাইর করে আবার সাটার টানে। আমাগোরে ঢুকতে দেয় না। পরে শাওনের নাম কওনে ঢুকতে দিছে। আমার পোলার চেহারা তো আমি চিনি। যাইয়্যা দেহি আমার পোলার সামনে কেউ নাই। ওয় পইর্যা রইছে। বেটার লাইফ হাসপাতাল থেইকা আমারে একটা ভিডিও ফুটেজ ওরা দিছে। পোলাটা ১০ মিনিটে বাইচ্যা আছিলো না ।
তিনি বলেন, ‘ওয়ান থোন কইলো ময়না তদন্তের জন্য শাওনরে ঢাকা মেডিকেলে নিতে। হাসপাতাল থোন বাইর হইয়া আত্মীয়- স্বজনের লগে কথা কইলাম। ওরা কইলো যে ঢাকা মেডিকেল নেওন লাগবো না। ঢাকা মেডিকেল নিলে ওর শইল্যের সব রাইখ্যা দিবো। অল্প বইস্যা পোলা। আডারো বয়স মাত্র। পোস্টমর্টেম করি নাই। অনেক কষ্টে সদরঘাট যখন পৌঁছাইছি হুনি লঞ্চঘাট বন্ধ। কোন লঞ্চ যাইব না। পরে, হিজলার দিকে যায় এমুন একটা লঞ্চে অনেক রিকোয়েস্ট কইরা শাওনরে তুলছি। নদী পার কইরা গেরামে পৌঁছাইছি। দাফন কাফন কইরা হেরে কবরে রাখছি।’
গত ১৯ জুলাই রামপুরা ও বনশ্রী এলাকাসহ এর আশেপাশে পুলিশ-বিজিবি সদস্যরা আন্দোলনরত ছাত্র ও জনতার ওপর টিয়ারশেল নিক্ষেপ ও ব্যাপক গুলি বর্ষণ করেছিল। এদিন দফায় দফায় এ এলাকার পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে থাকে; রূপ নেয় রণক্ষেত্রে। নিহত হয় অনেক বিক্ষোভকারী। আহত হয় অনেকে। জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশ ও বিজিবিকে ধাওয়া দেয়। পাল্টা ধাওয়া দিয়ে পুলিশ-বিজিবিসহ সরকার দলীয় অন্যান্যরা সড়কের পাশে অলিতে-গলিতে ঢুকে। পুলিশ নির্বিচারে গুলি করে আর পাখির মতো নিরীহ মানুষ মারে।
গত ১৯ জুলাই শুক্রবার জুম্মার নামাজ আদায় শেষে মসজিদ থেকে বের হয়েই গুলিবিদ্ধ হন প্রিন্স রেস্তোরাঁর দুই স্টাফ শাওন ও আজিজ। রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ভবনের উল্টোদিকে অবস্থিত হায়দার আলী প্রিন্স রেস্তোরাঁর পিছন দিকে একরামুন্নেসা স্কুল এন্ড কলেজের সামনে গুলিবিদ্ধ হন তারা। আজিজ বুকে গুলি খেয়ে আহত হয়ে বেঁচে থাকলেও পেটে গুলি খেয়ে শহিদ হন আঠারো বছর বয়সী শাওন।
সারোয়ার হোসেন শাওন বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া ইউনিয়নের পানবাড়িয়া গ্রামে ২০০৬ সালের ৩ জুন জন্ম নেন। তার বাবা জাকির হোসেন (৪০) একজন ভাসমান দিনমজুর এবং মা মোসাম্মৎ সেলিনা বেগম (৩০) গৃহিণী। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে শাওন ছিল বড়। তার এক বোন নবম শ্রেণিতে এবং ছোট ভাই মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে। বাবা শনির আখড়া আর মা ও ভাইবোনেরা গ্রামেই থাকেন।
শাওনের সহকর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শী মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘জুম্মা পইরা আমরা শাওনসহ এক লগে বাইর হইছি। ওই সময় ঘটনাটা ঘটছে। আমরা কয়েকজন রাস্তার পাশে দাঁড়াইয়া ছিলাম। রাস্তায় তখন গোলাগুলি চলছিল। রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকায় নামাজের পর আজিজ চুল কাটার জন্য মূল রাস্তার দিকে যাচ্ছিল। আর শাওন বাইর হইছিল কিছু খাবার কেনার জন্য। রামপুরা একরামুন্নেসা স্কুল এন্ড কলেজের গেটের কাছে ওরা দুইজন এগুতেই দুইজনরে কাছ থেইকা গুলি করে পুলিশ। আমি একটু পিছনে ছিলাম সেই সময়। আমি থতমত খাইয়া যাই। হের পর মালিকরে মোবাইলে কল দিই। মালিকের কওনের পর ওগোরে লইয়া একাই বেটার লাইফ হাসপাতালের দিকে যাই।’
তিনি বলেন, ‘বসরে বলছিলাম আমি তো একা, কাউরে পাঠাইতে। ওই সময় কোন কিছু না পাইয়া একটা ভ্যানে ওগো দুইজনরে উঠাই। ভ্যান পিছনের দিকে ঠেলে নিয়া যাইতে সময় লাগতেছিল। তহন একটা অটো রিকশা পায়া ওতে উডাইয়া হাসপাতালে লইয়া যাই। এসময় আজিজ উহু আহা করছিল। শাওনও কিছু বলছিল না।’
জাকির বলেন, ‘বসের কাছে শুইন্যা রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার ও একজন ওয়েটার শাওনের কাছে যাওয়ার জন্য বাইর হয়। কিন্তু তারা বাধা পায়। রাস্তার মধ্যে আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মীরা তাদের পথ আটকায়। মাইরধইর করে তাগো দুইজনরে। তারা ধাওয়া আর মাইর খাইয়া হাসপাতাল পর্যন্ত যাইতে পারে নাই। ফেরত আসে। পরে জীবনের ঝুঁকি নিয়া রেস্টুরেন্টের একজন শেফ হাসপাতালে শাওনের কাছে ছুটে যান।’
প্রত্যক্ষদর্শী জাকির বলেন, হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তাররা ওগোরে ভিতরেও নিয়া যায় হুইল চেয়ারে কইরা। আজিজের বুকের মধ্যে ব্যান্ডেজ বাইন্দা দিছে। বলছে ওরে ঢাকা মেডিকেলে লইয়া যাইতে। বস পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আইসা পড়ে। বসসহ আমি আজিজরে ঢাকা মেডিক্যালের ইর্মাজেন্সিতে নিয়ে যাই। তহন বিকাল চারটা পাঁচটা হবে। ডাক্তাররা আজিজের চিকিৎসা করছিল। কিছুক্ষণ পরে শুনলাম শাওন মারা গেছে।
রেস্তোরাঁর মালিক মোহাম্মদ মাসুদ বাসসকে বলেন, ‘শাওন ছয় মাস ধরে এখানে আমার প্রতিষ্ঠানে গ্লাস বয়ের কাজ করতো। রেস্টুরেন্টের পেছনে দোতালায় অন্যদের সঙ্গে স্টাফ রুমে থাকতো। যেদিন ঘটনা ঘটে সেদিন রামপুরা ও সংলগ্ন এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। আন্দোলনে ছাত্র জনতা ও পুলিশের ধাওয়া ও পাল্টা ধাওয়ার মুখে এলাকার সব দোকানপাটই বন্ধ ছিল।’
মাসুদ বলেন, ‘আমি মসজিদ থেকে নামাজ শেষ করে বের হয়ে আসি। কিন্তু দোকানের কাছে যেতে পারিনি। তখন টিয়ারশেল মারছিল পুলিশ। আমিসহ যারা মসজিদে ছিলাম তারা দৌড়ে আবার মসজিদে ঢুকে আশ্রয় নেই। এরপর আমি মসজিদে শুয়ে থাকি। প্রায় এক ঘণ্টা পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বের হয়ে আসি মসজিদের পেছনের রাস্তা দিয়ে। সামনের রাস্তা দিয়ে বের হওয়ার মতো কোন অবস্থাই ছিল না।’
তিনি বলেন, রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকায় ওই দিকে না গিয়ে নিজের বাসা যাত্রাবাড়িতে পৌঁছানোর জন্যে হাতিরঝিলের দিকে এগিয়ে যাই। একটা বাইক (মটরসাইকেল) খুঁজতে থাকি। এলাকায় ঝামেলা থাকায় বাইক ড্রাইভার ৭০০ টাকার বিনিময়ে যাত্রাবাড়ি পৌঁছে দিতে রাজি হয়। কিন্তু আরেকটু কম টাকায় বাইক পাওয়ার আশায় এগোতে থাকি। এমন সময় বেলা আনুমানিক তিনটার দিকে রেস্তোরাঁর স্টাফ জাকির ফোন করে জানায় রেস্টুরেন্টের গলির ভেতর আমাদের দুই কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আমি শুনেই নির্দেশ দিই স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতাল-বেটার লাইফে নিয়ে যেতে।
তিনি জানান, এরমধ্যে আমি শাওনের বাবাকে ফোন দিয়ে বিষয়টা জানিয়ে দ্রুত আসতে বলি। শুনলাম জাকির দুজনকে বেটার লাইফ হাসপাতালে নিয়ে আসছে।এর মধ্যে আমি ওখানে পৌঁছে যাই।
তিনি জানান, শাওনের পেটে গুলি লেগেছিল। কিন্তু তার রক্তপাত আমাদের চোখে এতো পড়ে নাই দেখে মনে হয়েছে, তার সমস্যা কম। আজিজ বুকে গুলি খেয়েছে, ডাক্তার বলছে এই ছেলে বাঁচবে না। আজিজের বাম বাহু দিয়ে গুলি ঢুকে বুক দিয়ে বের হয়ে গেছে । আজিজের শরীরের ভেতর গুলি না থাকায় সে বেঁচে যায়। ডাক্তারের পরামর্শেই বাইরে এসে একটা রেড ক্রিসেন্টের অ্যাম্বুলেন্স দেখতে পেয়ে ওকে ধরাধরি করে উঠায়ে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যাই। তখন জাকিরের কাছে জানতে পারি ডাক্তাররা শাওনকে চিকিৎসা দিয়ে চেয়ারে বসিয়ে রেখেছে।
শাওনের বাবা জাকির হোসেন বলেন, ‘যেদিন মারা গেছে সেই দিনের আগের রাইতেও কথা বলছি তার সাথে। বলছি, বাবা আমি তো বাইত যাইতাম চাই, তুমি কি বলো? শুনে সে বলে, বাবা বাইত গেলে যাইবেন আমার কওনের কিছু নাই। হে তহন রামপুরা ছিল,আমি ছিলাম শনির আখড়ায়।’
তিনি বলেন, ‘শুক্রবার কাজকাম না থাকায় বন্ধু বান্ধব লইয়্যা আড্ডা মারতে আছিলাম। এমন সময় ওর মায়ে ফোন দিছে। বলছে শাওনের মোবাইল বন্ধ, একটা কল দাও। আমি শাওনের মোবাইলে ফোন দেই ওর ফোন বন্ধ দেহি। আমি দোকানের মালিকরে ফোন দেই, জানতে পারি সে গুলি খাইছে।
তিনি বলেন, আমি অনেক কষ্টে রামপুরায় আইছি। জীবনরে জীবন মনে করি নাই। ১৯ জুলাই কি হইতাছে বুঝতে পারতাছিলাম না। অনেক মানুষ বাধা দিছে, রামপুরায় ঢুকতে পারি নাই। আমি আর একজন বন্ধু হেসে অনেক ঘুইরা বেটার লাইফ হাসপাতালের সামনে আইছি।
তিনি বলেন, গ্রামের স্কুলে ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়ছে শাওন। হেসুম করোনার সময় স্কুল কলেজ বন্ধ আছিল। তহন মনে করছি বদ পোলাদের লগে থাইকা ঘুরবো,নেশা ভাং করবো,হের লাইগ্যা ওর চাচাতো ভাইয়ের লগে ঢাহায় পাডাইছি। সাড়ে তিনবছর রামপুরায় মোট দুইডা রেস্টুরেন্টে কাম করছে। শেষ কর্মস্থলে মাসে ৮ হাজার টাকা বেতন পাইতো।
জাকির হোসেন বলেন, ‘ভাবছিলাম চাকরি করলে বাহে একটুখানি হেল্প পায়। এ লিগ্যা ওরে চাকরিতে দেছেলাম। পোলাপাইনের ভরসা যদি থাকে বাহের, একটুখানি হেল্প পায় বাহে। নিজের জানডায় কষ্ট দিয়া অনেক কিছু করছি। জানডায় আরাম পাইলাম না।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি আর শাওনে কাম-কাজ কইরা একটু জায়গা জমি করছিলাম, ঘরবাড়ি করছিলাম। ওয় মাসে মাসে যা দিত তাতেই আমি খুশি থাকতাম। আমার পোলা ১০ টাকা দিলেও আমি শুকুর করতাম। হেই পোলা আর নাই। আমার পোলাটা এইভাবে চইল্যা যাইবো,গুলি খাইবো বিনা অপরাধে আমি তা বুঝতেও পারি নাই। যদি বুঝতাম তাইলে আমার পোলারে আমি শহরে পাডাইতাম না।’ [সূত্র: বাসস]