পাঠ্যপুস্তকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বীরত্বগাঁথার অন্তর্ভুক্তি নিয়ে শিক্ষা অধিকার সংসদের গোলটেবিল আলোচনা
শিক্ষা অধিকার সংসদের পক্ষ থেকে পাঠ্যপুস্তকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বীরত্বগাঁথার অন্তর্ভুক্তি নিয়ে প্রস্তাব ও গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করা হয়েছে। শনিবার (১৬ নভেম্বর) জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমিতে (নায়েম) আলোচনার আয়োজন করা হয়।
গোলটেবিল আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন শিক্ষা অধিকার সংসদের আহ্বায়ক ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির প্রফেসরিয়াল ফেলো অধ্যাপক ড. এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ। পরিচালনা করেন সংগঠনের সদস্য সচিব এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন। সভায় শিক্ষা অধিকার সংসদ পাঠ্যপুস্তকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বীরত্বগাঁথার অন্তর্ভুক্তি এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মানহীন বিষয়বস্তু বাদ দেয়ার বিষয়ে প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।
এতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজিমউদ্দিন খান, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক হোসনে আরা বেগম। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ড. সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ, ইনকিলাব মঞ্চের শরিফ ওসমান হাদী, শিক্ষা গবেষক রাখাল রাহা, শহীদ আনাসের মা-বাবা, শহীদ সাজিদের বোন, আহত শিক্ষার্থী জসিম উদ্দিন। শিক্ষা গবেষক, শিক্ষক, এনজিওকর্মী ও সাংবাদিকরাও আলোচনায় অংশ নেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আমি ছাত্রনেতা নই, শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবেই আমরা আন্দোলন শুরু করি। এতদিন বিশেষ করে গত ১৫ বছরে মিডিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় যে বন্দনা ছিল তার পরিবর্তন দরকার। শিক্ষার সূত্রেই আমি কারিকুলামসহ বিভিন্ন বিষয় পড়েছি। নিজেও শিক্ষাদানের সঙ্গে যুক্ত। বুদ্ধিজীবীদের সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী ইতিহাসকে ব্রাকেটবন্দী করে।
আমি যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে তখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। অর্থাৎ তাদের ম্যানিপুলেডেট ইতিহাসই আমরা পড়েছি। ২৪ এর গণঅভু্যত্থানকে আংশিক ইতিহাস হিসেবে যেভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হচ্ছে, এটা বন্ধ করা দরকার। বরং একাত্তরের মতো ২৪ আন্দোলনকে পুরো ইতিহাসের অংশ হিসেবে দেখতে হবে। কোটি কোটি টন কাগজ নষ্ট করা হয় ম্যানিপুলেটেড ইতিহাসের জন্য। বুদ্ধিজীবীতার এক দৈন দশা দেখছি। ইনক্লুসিভ ইতিহাস দরকার। ২৪ কে কেন্দ্র করেই যে কেবল ইতিহাস সৃষ্টি হবে, তা নয়। এর পূর্বেও ইতিহাসে যার যে অবদান আছে সেভাবে উপস্থাপন করতে হবে। আমাদের চিন্তাকে ইতিহাসে একাডেমিক্যালি এন্ডর্স করতে হবে। শিক্ষার্থীদের অবদানকে কীভাবে একাডেমিক্যালি উপস্থাপন করা যায় সেটা জরুরি। পোলাপান রক্ত দিয়ে বিপ্লব করে, পরে মুরুব্বিরা পোস্ট ভাগাভাগি করে।
আহত শিক্ষার্থী জসিম উদ্দিন বলেন, ১৮ জুলাই আমি আন্দোলনে আহত হই। চারটা হাসপাতালে আমার চারটা অপারেশন হয়। পাঠ্যপুস্তকে শেখ মুজিবকে যেভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে, তার ফলে দেখা যায় দুই হাজার মানুষ নিহত হওয়ার পরও যতটা বিক্ষুব্ধ হওয়া উচিত ছিল, তার চাইতে কেউ কেউ শেখ মুজিবের ম্যুরাল ভাঙ্গায় বিক্ষুব্ধ হচ্ছে। স্কুল কলেজে যেই ইতিহাস পড়া হয়, এর বাইরে আর ইতিহাস পড়া হয় না বলেই ২৪কে যুক্ত করতে হবে। ক্লাস ফোরের বাচ্চাও আন্দোলনে যেতে চায়, কারণ তার ভাষায় আমার ভাইদের মারা হয়েছে। বাচ্চারা যেভাবে নিজেদের এই আন্দোলনকে ওউন করেছে।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞ রাখাল রাহা, গত ১৫ বছরে শিক্ষায় যে অধঃপতন হয়েছে, তা আগে কখনও হয়নি। প্রশ্ন ফাঁসের আন্দোলনে আমি গুম হই। পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত করার ক্ষেত্রে আবেগ আক্রান্ত হওয়া যাবে। পাঠ্যপুস্তকে ২০০৮ চরমভাবে ইন্টারফেয়ার করা হয়েছে। ইতিহাসের অতিকথন হয়েছে। একাত্তরের পরে যে অতিকথন হয়েছে, সেটা বাদ দিলে আমরা ভাবতে পারবো জুলাই। জুলাইয়ে বীরত্ব থাকছে, শহীদ আনাসের মা যেভাবে বললেন সেভাবে থাকবে। আগামী বছর বিস্তারিত কাজ করে হয়ত যুক্ত হবে। ঐক্যবদ্ধতাই জুলাইকে রক্ষা করতে হবে। তাড়াহুড়া করে বিনষ্ট।
ন্যাশনাল কারিকুলাম কোঅ-ির্ডনেশন কমিটির সদস্য অধ্যাপক সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া বলেন, গণঅভ্যুত্থানের বীরত্বগাঁথা নিশ্চয়ই যুক্ত হবে। আগামী বছর মূল টার্গেট করতে হবে। আমাদের কারিকুলামে কী রাখা হবে চিন্তা করেই রাখা দরকার। ভিশন মিশনটা আগে ঠিক করতে হবে। নতুন মেথডোলজি ২০২৩ এ যে শিক্ষাক্রম করা হয়, গবেষণা করা দরকার। ফিনল্যান্ডের শিক্ষার অনেক সমালোচনা আছে। ফিনল্যান্ড লার্নার্স অরিয়েন্টেড, অন্যরা ইন্ড্রস্টিবেজড। শিক্ষা কারিকুলামে আমাদের বিষয়গুলো যুক্ত করা জরুরি।
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক হোসনে আরা বেগম বলেন, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পাঠ্যপুস্তকে জুলাই ইতিহাস ঢুকানোর কাজটি করতে হবে। যাতে পরবর্তীতে এটা নিয়ে কথা না উঠে। সমৃদ্ধ কারিকুলাম। বর্তমান প্রজন্ম যখন দেখবে, তাদের ইতিহাস যুক্ত হয়েছে, তারা অত্যন্ত খুশী হবে।
অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান বলেন, আরসি মজুমদার অডিটরিয়ামে আমরা যখন গত শিক্ষাক্রম নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলা করতে দেওয়া হয়নি। দেশপ্রেম পণ্য হয়ে গিয়েছিল সেটা শিক্ষা দিয়ে শুরু। আমরা যখন ইতিহাস লিখবো, সেভাবে লিখতে। শিশুদের জন্য লিখতে গেলে শিশুর মনস্তত্ত্ব বুঝেন, তাদের নিয়ে লেখা। আমাদের ইতিহাস কেন বায়ান্ন আর একাত্তরে পড়ে থাকবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষায় রাষ্ট্রের ব্যয় সবচেয়ে কম। আফগানিস্তানের চেয়ে কম। এখানে জোর দিতে হবে। নতুন বাংলাদেশ গঠনে জোর দিতে হবে। বৈচিত্র্যকে ধারণ করতে হবে। সেই ভাবনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে।
শিক্ষা অধিকার সংসদ-এর আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ; বলেন সুপ্রিমেসির বাইরে এসে শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করব। তরুণদের অংশগ্রহণে গণতন্ত্রায়ণ করা। শিক্ষায় বাজেটে অবশ্যই বাড়াতে হবে। জুলাই বিপ্লবের আলোকে কীভাবে শিক্ষাকে সাজানো যায় সেটা আবারও চিন্তার আলোকে আমরা করব। আলোচনা থেকে শিক্ষা অধিকার সংসদ কয়েকটি প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়।