২৫ বছর পর পরিবারের কাছে যেভাবে ফিরলেন জাহানারা
কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার জাঙ্গালিয়া বাজারে এক নারী ঘোরাফেরা করছিলেন দু-তিন সপ্তাহ ধরে। পরে জাঙ্গালিয়া বাজার কমিটির সভাপতি আশরাফুল আলম তাকে বাড়িতে নিয়ে যান। পরিচয় জানতে চাইলে তিনি নাম বলেন জাহানারা বেগম। তবে ঠিকমতো বাড়ির ঠিকানা বা পরিবারের কারও নাম বলতে পারেন না। শুধু আমতা আমতা করে ‘বরগুনা ও ঘটবাড়িয়া’ শব্দগুলো উচ্চারণ করেন।
জাহানারার কথাগুলো লিখে ও তার ছবি দিয়ে আশরাফুল আলম ফেসবুক অ্যাকাউন্টে সম্প্রতি একটি পোস্ট দেন। এই পোস্ট দেখে বরগুনা থেকে যোগাযোগ করেন এক পরিবার এবং শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) দুপুরে তারা পাকুন্দিয়ায় আসেন। পরে জাহানারাকে তার পরিবার ও মেয়ে হাসি আক্তারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
শুক্রবার দুপুরে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার জাঙ্গালিয়া বাজার এলাকা থেকে তাকে নিয়ে যান তার ছোট মেয়ে হাসি আক্তার এবং বোনের স্বামী মোস্তফা মির্জা। এতে প্রায় ২৫ বছর পর হারিয়ে যাওয়া স্বজনকে ফিরে পেয়ে এব আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
জাহানারা বরগুনা সদর উপজেলার ঘটবাড়িয়া গ্রামের আবদুল লতিফের স্ত্রী এবং পাঁচ সন্তানের জননী। ১৯৯৯ সালে ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন তিনি।
পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৯৯ সালে জাহানারা বেগম তার তিন বছরের ছোট ছেলে সাইদুলসহ অন্যদের নিয়ে বরগুনা থেকে ঢাকায় আত্মীয়ের বাসার উদ্দেশে রওনা হন। ভোরে সদরঘাটে লঞ্চ থেকে নেমে শৌচাগারে যান। এরপর থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার আত্মীয়স্বজন সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজেন তাকে। দীর্ঘদিন সন্ধান না পাওয়ায় তাকে পাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছিল পরিবার।
জাহানারার ভগ্নিপতি মোস্তফা মির্জা বলেন, তারা জাহানারার সঙ্গে কথা বলেন এবং হারানোর সময় ছোট ছেলে ও সদরঘাট লঞ্চঘাটের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তখন জাহানারার কিছু কথা ঘটনার সঙ্গে মিলে যায়। ২৫ বছর চলে গেছে। অযত্ন-অবহেলায় এত দিনে জাহানারার চেহারায়ও অনেক পরিবর্তন এসেছে। জাহানারা হারিয়ে যাওয়ার সময় তার মেয়ে হাসি ছিলেন পাঁচ বছর বয়সী। মায়ের চেহারা হাসির তেমন একটা মনে না থাকলেও তিনি ঠিকই চিনতে পারেন জাহানারাকে।
এদিকে দীর্ঘদিন পর মাকে কাছে পেয়ে কেঁদে ফেলেন ছোট মেয়ে হাসি বেগম। তিনি বলেন, ‘আমার বয়স যখন ৫ বছর, তখন মাকে হারিয়েছি। ছোটবেলায় মা আমাদের রেখে কোথায় যেন হারিয়ে যান। মায়ের আদর পাইনি। কত জায়গায় যে মাকে খুঁজেছি। কোথাও খুঁজে পাইনি। আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম মায়ের মুখ আর দেখতে পাব না, মাকে আর খুঁজে পাব না। আমার বয়স এখন ৩০ বছর। সংসার করছি। কিন্তু আল্লাহর কী অশেষ রহমত, এত দিন পর আমরা মাকে খুঁজে পেলাম। মনে হচ্ছে যেন পৃথিবী খুঁজে পেলাম। মাকে খুঁজে দেওয়ার জন্য পাকুন্দিয়ার লোকজনসহ সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।’
জাঙ্গালিয়া বাজার কমিটির সভাপতি আশরাফুল আলম বলেন, দু-তিন সপ্তাহ ধরে ওই নারী আমার দোকানের সামনে ছিলেন। কথা বলে মনে হয়েছে, তিনি মানসিকভাবে ঠিকই আছেন। কথাবার্তা শুনে সপ্তাহখানেক হলো জাহানারাকে বাড়িতে নিয়ে আসি। জানতে চাই তার পরিবারের কথা। কথা স্পষ্ট না হলেও তার ছবি দিয়ে দু-এক কথা লিখে ফেসবুকে পোস্ট করি। পোস্টটি জাহানারার পরিবারের নজরে আসে। পরে তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
জাহানারা বেগমকে পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করার সময় স্থানীয় জাঙ্গালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ওমর ফারুক, সাবেক চেয়ারম্যান তৌফিকুল ইসলাম, স্থানীয় শিক্ষক শফিকুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য আবুল কালামসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।