বিসিএস নিয়োগে নিজেই তথ্য দিয়ে ফেঁসে যাচ্ছেন অনেকে
বিসিএসে উত্তীর্ণ হওয়ার পর চাকরি নিশ্চিত করতে যাচাই-বাছাইয়ের সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য অনেকে নিজেই পুলিশকে দিয়েছিলেন। কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ায় সেসব তথ্যই এখন তাদের জন্য গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রতিবেদনের তথ্য নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে চাকরিপ্রার্থীদের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে দেখা হচ্ছে। যাদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলবে, তাদের নিয়োগ ঝুলে যাবে। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে আজকের পত্রিকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি চাকরিপ্রার্থীদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা খোঁজা পুলিশের কাজ নয়। নিয়ম মেনে পুলিশ ভেরিফিকেশন করে এই সংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে।
সূত্র বলেছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতার থাকাকালে গত ১৫ বছরে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা পেয়েছে, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সুপারিশের পরও তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি। রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে পতিত সরকারের সময়ে ২৮তম থেকে ৪২তম বিসিএস পর্যন্ত ২৫৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তবে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ১৪ আগস্ট তাদের নিয়োগ দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে।
জানা যায়, গত ১৫ অক্টোবর ৪৩তম বিসিএসে উত্তীর্ণদের নিয়োগ দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়।
২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর ক্যাডার পদে ২ হাজার ১৬৩ জনকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছিল পিএসসি। তাদের তথ্য-উপাত্ত অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পুলিশের এসবিকে দিয়ে আবার যাচাই করলে প্রায় একই ধরনের তথ্য আসে।
এরপর গত মাসেই ৪৩তম বিসিএসের ২ হাজার ৬৪ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগ দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। নিয়োগের জন্য পিএসসির সুপারিশ পাওয়া ৯৯ জনকে গেজেটভুক্ত করা হয়নি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ৪৩তম বিসিএসে গেজেটভুক্তদের ১৭ নভেম্বরের মধ্যে নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়ে যোগ দিতে বলা হয়েছিল। তবে পুলিশ ভেরিফিকেশনে যাদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার তথ্য রয়েছে, সেগুলো আবার যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ জন্য গেজেটভুক্তদের ১৭ নভেম্বরের পরিবর্তে ১ জানুয়ারি যোগ দিতে বলা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এসবির রিপোর্টে অনেকের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার প্রমাণ রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার সেসব প্রমাণ যাচাই করছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পতিত সরকারের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন, এমন কাউকেই বিসিএসের মতো চাকরিতে আনতে চায় না সরকার। এ জন্য জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) এবং প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরকে (ডিজিএফআই) দিয়ে নতুন করে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার তথ্য যাচাই করা হচ্ছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, এর আগে বাদ দেওয়া প্রার্থীদের তথ্যও আবার যাচাই করা হচ্ছে। তার ধারণা, প্রার্থীদের অনেকে গেজেটভুক্ত হবেন এবং আগে গেজেটভুক্তদের কেউ কেউ বাদ পড়বেন।
সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকা প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক পুলিশি প্রতিবেদন দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। এ জন্য সরকারি চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর অনেকেই ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা আওয়ামী লীগের সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য নিজ উদ্যোগেই পুলিশকে দিয়েছেন। পুলিশ কর্মকর্তারাও নিজের সুবিধার কথা ভেবে সেসব তথ্য যুক্ত করেই ভেরিফিকেশন প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। সেসব তথ্যই এখন অনেকের জন্য চাকরি হারানোর শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একজন প্রার্থীর প্রাক-যাচাই ফরমে ১৬ ধরনের তথ্য দিতে হয়। সাধারণ তথ্যের পাশাপাশি তিনি কোনো মামলায় গ্রেপ্তার, অভিযুক্ত বা দণ্ডিত হয়েছেন কি না, এই তথ্যও চাওয়া হয়। উত্তীর্ণ হওয়ার পর এসব যাচাই করে এসবি প্রতিবেদন দেয়। এর বাইরে অন্য কোনো তথ্য যাচাইয়ের কথা না থাকলেও বছরের পর বছর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রার্থীর পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই করছে। যদিও ফৌজদারি অপরাধ করে না থাকলে কাউকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগবঞ্চিত করা যায় না।
৪৩তম বিসিএসে গেজেটভুক্ত একজন প্রার্থী বলেন, তিনি কখনোই ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তবে পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনি তৎকালীন সরকারদলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এটি তিনি পুলিশকে অনুরোধ করে লিখিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের স্থানীয় তৎকালীন এমপির একটি প্রত্যয়নপত্রও ভেরিফিকেশনের সময় পুলিশকে দিয়েছিলেন। বর্তমানে পলাতক ওই এমপি কয়েকটি হত্যা মামলার আসামি। গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন এসব জানলে গেজেট বাতিল হয় কি না, সেই চিন্তায় আছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, শুধু ৪৩তম বিসিএস নয়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এর আগে কয়েকটি বিসিএসে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের মধ্যে যাদের বেশি রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ রয়েছে, সেসব আবার যাচাই করা হবে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলেন, সরকারি চাকরিতে নিয়োগের আগে কোনো প্রার্থী ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত কি না এবং তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ আছে কি না, সেটি পুলিশের খতিয়ে দেখার কথা। কে কোন দল করেন, কোন সংগঠনের সদস্য, সেটি পুলিশের বিবেচনার বিষয় নয়। কিন্তু গত সরকারের সময় এটিই প্রাধান্য পেয়েছে। এটি উচিত নয়। কারণ, বাংলাদেশের সব নাগরিকের সরকারি চাকরি পাওয়ার অধিকার আছে।
তিনি বলেন, নিয়ম মেনে পুলিশ ভেরিফিকেশনের কাজটি করলে অযথা কেউ চাকরি থেকে বঞ্চিত হবেন না।
রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলে কাউকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগবঞ্চিত করার সুযোগ নেই বলে জানান ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া গেলে নিয়োগ দেওয়া যাবে না, এটা তো কোনো কথা নয়। কারণ, আমার রাজনৈতিক পরিচয় তো আমার সাংবিধানিক অধিকার। আমার রাজনৈতিক বিশ্বাস তো কোনো অবৈধ কিছু না। আওয়ামী লীগ সরকার এটিকে ট্রেন্ড হিসেবে তৈরি করেছিল বলে এখনকার সরকারও করবে, এটার কোনো যুক্তি নেই। এই কালচার বন্ধ করা উচিত।’