যেভাবে বিচারপতি অপসারণ করতে পারবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল
বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফেরাতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। ২০১১ সালে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান অপরিবর্তিত রেখে জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়। ২০১৪ সালে ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা আবারও সংসদের হাতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে তা অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। একই বছরের ৩ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতিতে আপিলটি খারিজ করে রায় দেন। ২০১৭ সালের ১ আগস্ট আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। পরে একই বছরের ২৪ ডিসেম্বর ওই রায় রিভিউ চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
রোববার (২০ অক্টোবর) রিভিউ আবেদন পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ৬ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এই রায় দেন। এর ফলে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতেই ফিরে এল বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা এখন সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে। এই কাউন্সিলের কার্যক্রম কেমন হবে, সে বিষয়টি খোলাসা করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
রিভিউ নিষ্পত্তির পর রোববার নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলে কোনো অভিযোগ করলে বা পেলে তারা প্রাথমিক একটি অনুসন্ধান করবেন। যাচাই-বাছাই করে দেখবেন যে অসদাচরণ বা দুর্নীতি (অর্থনৈতিক বা বুদ্ধিভিত্তিক) পাওয়া গেছে কি না। তাহলে রিপোর্টটা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। রাষ্ট্রপতি বিচার-বিবেচনা করে তারপর আবার সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের কাছে পাঠাবেন। সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল তখন ফুল তদন্ত করবে।
আরও পড়ুন: আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোটের পথে হাঁটতে পারে বাংলাদেশ, কী এই ব্যবস্থা?
তিনি বলেন, এখানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতির। তবে এখানে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত মেকানিক্যাল। সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের দায়িত্ব হলো অসদাচরণ প্রমাণিত হয়েছে কি না, এটাসহ সুপারিশ পাঠানোর।
অ্যাটর্নি জেনারেল জানান, এ পর্যন্ত একজন বিচারপতিকে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে অপসারণ করা হয়। সেটা ২০০৪ সালের ২০ এপ্রিল হয়েছিল।
ষোড়শ সংশোধনীতে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল বাতিলের আগে সংবিধানের এ সংক্রান্ত ৯৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘(২) অনুচ্ছেদের নিম্নরূপ বিধানাবলি অনুযায়ী ব্যতীত কোনো বিচারককে তাহার পদ হইতে অপসারিত করা যাইবে না।’
‘(৩) একটি সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল থাকিবে, যাহা এই অনুচ্ছেদে ‘কাউন্সিল’ বলিয়া উল্লেখিত হইবে এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে পরবর্তী যে দুইজন কর্মে প্রবীণ তাহাদের লইয়া গঠিত হইবে।’
‘তবে শর্ত থাকে যে কাউন্সিল যদি কোনো সময়ে কাউন্সিলের সদস্য এইরূপ কোনো বিচারকের সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করেন, অথবা কাউন্সিলের কোনো সদস্য যদি অনুপস্থিত থাকেন অথবা অসুস্থতা কিংবা অন্য কোনো কারণে কার্য করিতে অসমর্থ্য হন, তাহা হইলে কাউন্সিলের যাহারা সদস্য আছেন, তাহাদের পরবর্তী যে বিচারক কর্মে প্রবীণ তিনিই অনুরূপ সদস্য হিসাবে কার্য করিবেন।’
(৪) কাউন্সিলের দায়িত্ব
‘(ক) বিচারকগণের জন্য পালনীয় আচরণবিধি নির্ধারণ করা; এবং
(খ) কোনো বিচারকের অথবা কোনো বিচারক যেরূপ পদ্ধতিতে অপসারিত হইতে পারেন সেইরূপ পদ্ধতি ব্যতীত তাহার পদ হইতে অপসারণযোগ্য নহেন এইরূপ অন্য কোনো পদে আসীন ব্যক্তির সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করা।
(৫) যে ক্ষেত্রে কাউন্সিল অথবা অন্য কোনো সূত্র হইতে প্রাপ্ত তথ্যে রাষ্ট্রপতির এইরূপ বুঝিবার কারণ থাকে যে কোনো বিচারক-
(ক) শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে তাহার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করিতে অযোগ্য হইয়া পড়িতে পারেন, অথবা
(খ) গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হইতে পারেন, সেই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করিতে ও উহার তদন্ত ফল জ্ঞাপন করিবার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন।
(৬) কাউন্সিল তদন্ত করিবার পর রাষ্ট্রপতির নিকট যদি এইরূপ রিপোর্ট করেন যে উহার মতে উক্ত বিচারক তাহার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে অযোগ্য হইয়া পড়িয়াছেন অথবা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হইয়াছেন, তাহা হইলে রাষ্ট্রপতি আদেশের দ্বারা উক্ত বিচারককে তাহার পদ হইতে অপসারিত করিবেন।
(৭) এই অনুচ্ছেদের অধীনে তদন্তের উদ্দেশ্যে কাউন্সিল স্বীয় কার্যপদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করিবেন এবং পরওয়ানা জারি ও নির্বাহের ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের ন্যায় উহার একই ক্ষমতা থাকিবে।’
১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয়। পরে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয় সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের কাছে। মার্শাল প্রক্লেমেশনে করা পঞ্চম সংশোধনীতে এ ক্ষেত্রে ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনা হয়েছিল।
২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ষোড়শ সংশোধনীতে সেটা বাতিল করে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয় সংসদকে। বিলটি পাসের পর একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।
আরও পড়ুন: আইনজীবী জেড আই খান পান্নার বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলা
সংবিধানের এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয় আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। এ রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে একই বছরের ৯ নভেম্বর এ সংশোধনী কেন অবৈধ, বাতিল ও সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
রুল শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ।
রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাওয়ার পর ২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারি এ বিষয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।
ওই আপিলের শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ৩ জুলাই হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে সর্বসম্মতিক্রমে চূড়ান্ত রায়টি দেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ। পরে একই বছরের ১ আগস্ট ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হয়। এ রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে।
রোববার সেই রিভিউ আবেদন পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ।
ফলে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের রায় বহাল থাকল। একই সঙ্গে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে ফিরেছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো.আসাদুজ্জামান। রিটকারী পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
আদালতের বন্ধু হিসেবে শুনানিতে মত দিয়েছেন সিনিয়র অ্যাভোকেট রুহুল কুদ্দুস কাজল। তিনি জানান, সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল সংক্রান্ত সংবিধানের ৯৬ (২,৩,৪,৫,৬,৭ ও ৮) অনুচ্ছেদ বহাল করা হয়েছে। আর পর্যবেক্ষণসহ রিভিউ নিষ্পত্তি করা হয়েছে।