১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৮:৫৬

নারীকে টেনে তুলতে গেলে গুলি ঢুকে যায় রাকিবের গলায়

মো. রাকিবুল হোসেন  © সংগৃহীত

এখনও ফ্রিজে জমা রয়েছে দুধ, গুড়, নারকেল, পুলিপিঠার পুর। নিস্তব্ধ ঘরের প্রতিটি জিনিস পরিপাটি সাজানো। টানটান বিছানার এক পাশে বালিশ। পড়ার টেবিলের তাকে তাকে সাজানো বই। ড্রয়িং রুমে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে প্রিয় মোটরসাইকেল। পাশেই কাপড় ধোয়ার মেশিন। পানিশূন্য পানির ফিল্টারের ভেতরটা শুষ্ক; পড়েছে আয়রনের হালকা আস্তরণ। কিন্তু কোথাও যেন কেউ নেই।

এমন নিস্তব্ধ শূন্যতার মাঝে নেই শুধু মো. রাকিবুল হোসেন (২৯)। গত ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সৃষ্ট সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন তিনি। সেই থেকে গ্রামের বাড়িতে তার সাজানো-গোছানো ঘরটি তার অপেক্ষায় সুনসান হয়ে আছে।

ঝিনাইদহ জেলার সদর পৌরসভার সার্কিট হাউস রোডের মহিষাকুন্ডু গ্রামের বাসিন্দা বিমানবাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার (অব.) আবু বকর সিদ্দিক (৬১) ও হাফিজা খাতুন (৫৮) দম্পতির ছেলে মো. রাকিবুল হোসেন।

রাকিব বনানী সুপার জুট মিলে চাকরি করতেন। ঢাকার মিরপুরে ১১ নম্বরে ভাড়া বাসায় থাকতেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে রাকিব ছোট। বড় ভাই  ইকবাল হোসেন (৩৭) সোনালী ব্যাংকের ঝিনাইদহ শাখায় সিনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত।

আরও পড়ুন: ‘আপনাদের তালা আমি ভেঙে দেব, তবে আমাদের বাঁচাতে হবে’

রাকিব নিহত হয়েছেন আজ ৮৩ দিন পেরিয়ে গেল। আজও থামেনি পরিবারের শোকের মাতম। বাড়িতে তিনজনের বসবাস। তবু কোথাও যেন কেউ নেই; নেই কোনো শব্দ। যে বাড়ির বিপ্লবী নক্ষত্র ঝরে গেছে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে, সেখানে কি আর কখনো শোরগোল জমে?

রাকিবের বাবা আবু বকর সিদ্দিক অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘আন্দোলনের সময় আমরা রাকিবকে ফোন করলে সে লোকজনের ভিড় থেকে সরে গিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলত। সে যে আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, এটা সে আমাদের বুঝতে দিতে চাইতো না। এসব কথা রাকিবুলের সহকর্মীরা পরে আমাদের জানিয়েছে।’

আরও পড়ুন: ‘মাথা-বুক রক্তে ভিজে যায়, বাঁ চোখ চেপে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি’

রাকিবের মা হাফিজা খাতুন বলেন, ‘১৮ জুলাই ঢাকায় যখন আন্দোলনে হামলা শুরু হয়, তখন থেকেই আমরা ভয়ে ছিলাম। শুধু ভাবতাম আমার রাকিব অফিসে যাবে কীভাবে? ১৯ জুলাই শুক্রবার রাকিবকে ফোন করে বললাম, আব্বু, অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফেরা যাবে না? আমার আব্বুটা বলেছিল, না মা, ফেরা যাবে না।’

এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন রাকিবের মা। নিজেকে সামলে আবার বলতে শুরু করেন, ‘১৯ জুলাই শুক্রবার, বেলা আড়াইটার পর আমার ছেলের সঙ্গে শেষ কথা হয়। রুটি আর ডিমভাজি দিয়ে সকালের নাশতা করেছিল আমার আব্বুটা।’

‘১৯ জুলাই মিরপুর ১১-তে মেট্রোরেল লাইনের নিচে আন্দোলনকারীদের মাঝে আমার ছেলে পানি বিতরণ করছিল। শিক্ষার্থীদের মাঝে সে যতক্ষণ ছিল, ততক্ষণ নিরাপদেই ছিল। যখনই সে পানি বিতরণ শেষে শিক্ষার্থীদের থেকে কিছুটা আলাদা হয়ে যায়, তখনই তাকে টার্গেট করে গুলি করা হয়। আমার ছেলের সঙ্গে থাকা সহকর্মীরা জানিয়েছে, ওপর থেকে গুলি এসে তার গলায় ঢুকে যায়। পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে আমার ছেলেটা মারা যায়,’ কেঁদে কেঁদে বলেন হাফিজা খাতুন।

বাবা আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘আমার ছেলের বন্ধু পিয়াস জানিয়েছে, সে সময় একজন বয়স্ক নারী দৌড়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে রাকিবের সামনে এসে পড়ে যান। ওই সময় রাকিব তাকে টেনে তুলতে এগিয়ে গিয়েছিল। আর তখনই ওপর থেকে নিখুঁত টার্গেটে আমার ছেলেকে গুলি করা হয়।’

তিনি জানান, রাকিবের বন্ধু পিয়াস প্রথম বাড়িতে খবর দেন। পিয়াসই রাকিবের অফিসের সহকর্মী  সালমান ও ফয়সালকে দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে মৃতদেহ ঢাকা থেকে ঝিনাইদহে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। হরিণাকুন্ডু উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে রাকিবকে দাফন করা হয়।

আরও পড়ুন: ডান পায়ে গুলি নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে নূপুরকে

১৯ জুলাই রাত ৮টার দিকে একমাত্র ভাতিজা রাফসানের (৪) সঙ্গেই রাকিবের শেষ কথা হয় বলে জানান রাকিবের মা,  ‘রাফসান রাকিবকে ‘ছোট আব্বু’ ডাকত। ফোনে কথা বলার সময় রাফসান রাকিবকে বলেছিল, ছোট আব্বু, তুমি বাড়ি চলে আসো। গাড়ি না পেলে তোমার বাইক নিয়ে চলে আসো। না হয় তুমি অ্যাম্বুলেন্সে বাড়ি চলে আসো। কে জানত চার বছরের অবুঝ শিশুটির সেই কথাই এমন নির্মম বাস্তবে পরিণত হবে! আমার রাকিব বাড়ি ফিরেছে ঠিকই। তার প্রিয় বাইক কিংবা গাড়িতে করে নয়, নিথর দেহে অ্যাম্বুলেন্সে চেপেই শেষবারের মতো বাড়ি ফিরল।’

‘আমার ছেলে পরপারের যাত্রী হয়েছে আজ ৮৩ দিন হলো। এই দিনগুলো কত কষ্টের তা আমরা ছাড়া আর কেউ জানে না। রাতে বিছানায় ঘুমাতে পারি না। আমার খোকার সখের মোটরসাইকেল, পড়ার টেবিল, হেলমেট, বই-পত্র দেখলেই বুক ফেটে কান্না আসে।’ আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন বাবা আবু বকর সিদ্দিক।

রাকিবের মা বলছিলেন রাকিব কোনো রাজনীতি করতেন না। তিনি শুধু তার মাকে বলেছিলেন যে ছোট ছোট ভাই-বোনেরা আন্দোলন করছে। তিনি যদি বড় ভাই হয়ে তাদের পাশে না দাঁড়ান, তাহলে তারা সাহস পাবে কোথায়?

রাকিব ঝোলা গুড়, নারকেল ও পুলিপিঠা পছন্দ করতো জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ঢাকায় যাবো বলে আমার রাকিব নতুন বাসা নিয়েছিল। আমি দুধ, নারকেল, ঝোলা গুড়, আটা গুছিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু সেই সবকিছু তেমনই আছে। আমার বাবাটা আর নেই। এসব খাবার আমি কি আর কোনো দিন মুখে নিতে পারব?’ বলেই হু হু করে কেঁদে ওঠেন রাকিবের মা।

আরও পড়ুন: ছাত্র আন্দোলনে রাবির একমাত্র শহীদ জহিরুল, জানা গেল দুই মাস পর

বাড়িতে থাকা রাকিবের বাইক দেখিয়ে তার বাবা বলেন, ‘প্রতিদিন এই বাইক আমি যত্ন করে মুছে রাখি। বাইকটা হাত দিয়ে স্পর্শ করি। কখনো কান্নাকাটি করি। বাইকটা স্পর্শ করলে মনে হয় আমার রাকিব আমার স্পর্শ টের পাচ্ছে।’

রাকিবের ব্যবহৃত ওয়াশিং মেশিন সযত্নে রেখে দিয়েছেন তার মা। ঘুরেফিরে তিনি ওয়াশিং মেশিনের কাছে যান। ছেলের হাতের স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করেন। ছেলের ব্যবহৃত হেলমেট হাতে নিয়ে আনমনে বসে থাকেন। তখন অঝোরে চোখ বেয়ে ঝরে পড়ে অশ্রুধারা।

সরকারের উদ্দেশে আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘আমাদের ছেলেরা একটা সুন্দর, মানবিক, সহিষ্ণু ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন নিয়ে রাজপথে আত্মদান করেছে। সরকারের কাছে অনুরোধ, যারা শহিদ হয়েছে তাদের যেন এই দেশ এই জাতি ভুলে না যায়। ফ্যাসিস্ট সরকারের নির্যাতনে হাজার হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। রাষ্ট্র যেন তাদের দায়িত্ব নেয়। এত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই নতুন স্বাধীনতা যেন, মলিন না হয়, সেই কামনা সরকার, রাষ্ট্র ও জাতির কাছে।’

তিনি জানান, রাকিবের মৃত্যুর পর বিএনপির পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ১ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছেন। তবে সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত কোনো অনুদান তারা পাননি।

সূত্র: বাসস