পাবনায় অবৈধ দখলে নদীর সংযোগ ক্যানেল, পাঁচ বিলের চাষাবাদ ব্যাহত
তিন যুগ ধরে কৃষিজমি চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন কৃষক আনোয়ার হোসেন (৫৫)। বিঘায় ধান পেতেন ২০ থেকে ২৫ মণ। বছরে দুবার পাওয়া সেই ধানে তার সারাবছরের খাবারের সংস্থান হতো। কিন্তু বিলে এখন আর দুবার চাষাবাদ করতে পারেন না। আগের মতো ফলনও পান না। কারণ বিলে পানি নেই, সেচ দিতে অধিক খরচও কুলিয়ে উঠতে পারেন না।
কারণ হিসেবে কৃষক আনোয়ার হোসেনের দাবি, বড়াল নদীর ক্যানেল দিয়ে বর্ষা মৌসুমে পানি চলাচল থাকত বিলে। পানি আসত, আবার সময়মতো নেমে যেত। এখন আর পানি আসে না। পানি নামতেও পারে না। নদীর সংযোগ ক্যানেল দখল হওয়ার ফলে চাষাবাদে সৃষ্টি হয়েছে সংকট।
এভাবেই দুঃখের কথা জানান পাবনার চাটমোহর উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়নের সাড়োরা গ্রামের কৃষক আনোয়ার হোসেন। শুধু আনোয়ার হোসেনই নন, তার মতো অন্যান্য কৃষকের হতাশার গল্পটা অনেকটা একই।
জবেরপুর গ্রামের মৎসজীবি আব্দুল হাকিম বলেন, ’আমরা এসব বিলে মাছ ধরে সংসার চালিয়েছি প্রায় ৩০ বছর। প্রচুর মাছ হতো। কিন্তু গত দশ বছর ধরে মাছ আর নাই বললেই চলে। সংসার চালাতে না পেরে সবাই অন্য পেশায় চলে গেছি। কেউ ভ্যান চালায়, কেউ দিনমজুরী করে।’
খোঁজ নিয়ে ও সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, চাটমোহর পৌর সদরের নতুন বাজার এলাকায় সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটি ক্যানেল। যা বড়াল নদীর সাথে সংযুক্ত করেছে স্থানীয় ৫টি বিলকে। বর্ষা মৌসুমে এই ক্যানেল দিয়ে পানি চলাচল করায় উপকারে আসতো হাজারো কৃষক-মৎসজীবিদের। কিন্তু বর্তমান চিত্র দেখে বোঝার উপায় নাই এখানে কোনো ক্যানেল আছে।
সরকারি এই ক্যানেল অবৈধভাবে দখল করে দোকানপাট ও বাড়িঘর নির্মাণ করেছে একটি চক্র। কেউ আবার নির্মাণ করেছেন পাকা স্থাপনা। কারও কোনো অনুমতি বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ইচ্ছামতো দখল করেছেন তারা। এতে দিনে দিনে ভরাট হয়ে যাচ্ছে কৃষক-মৎসজীবীদের জন্য আশীর্বাদ এই ক্যানেল। বর্ষা মৌসুমে পানি চলাচল করতে না পারায় ব্যাহত হচ্ছে স্থানীয় পাঁচটি বিলের পাঁচ হাজার বিঘা জমির ফসল উৎপাদন।
প্রশাসনের নাকের ডগায় এই দখল চললেও দেখার কেউ নেই। পরিবেশবিদদের অভিযোগ, এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েও সুরাহা মিলছে না।
ক্যানেলের ওপর দোকান করেছেন সিদ্দিকুর রহমান, মানিক শিকদার ও নুর হোসেনসহ অনেকে। তারা বলেন, ‘অবৈধ জেনেও আমরা ক্যানেলের ওপর দোকান করছি। সবাই করছে দেখে আমরাও করছি। কী করব, গরীব মানুষ, কিছু একটা করে খাচ্ছি। কেউ অনুমোদন নেয় নাই। আমরাও নিইনি। সরকারি জায়গার যে যেরকম পারছে দোকান করছে। সরকার যখন চায় ভেঙে দিবি।’
ক্যানেলের কোল ঘেঁষে বাড়ি করেছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য ইউনুস আলী। বাড়িতে যাওয়া-আসার জন্য ক্যানেলের ওপর পাকা ছোট সেতু করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি ক্যানেলের জায়গায় বাড়ি করিনি। আর আমার বাড়ি করার অনুমোদন আছে।’ তবে কাগজপত্র দেখতে চাইলে দেখাতে পারেননি তিনি।
আর পড়ুন: পাবনায় প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় গ্রেপ্তার যুবলীগ কর্মী
সাদী হাসান নামের আরেক দখলদার বাড়ি ও মুরগির খামার করেছেন ক্যানেলের মধ্যে। খামারের সব বিষ্ঠা ও ময়লা আবর্জনা ক্যানেলে ফেলেন। তিনি বলেন, ’আমার বাবা বেঁচে থাকতে ক্যানেলের ওপর দোকান করেছেন। সেটা আর ভাঙা হয়নি। সবাই যেভাবে করছে, আমিও করছি।’
এ ছাড়া সাড়োরা গ্রামে আবুল কাশেম নামের এক ব্যক্তি তার বাড়ির সামনে ক্যানেলটি মাটি দিয়ে ভরাট করে উঠোন বানিয়েছেন। তিনি স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ সবাইকে জানিয়েই মাটি ভরাট করেছেন বলে দাবি করেন।
স্থানীয় কৃষক মুকুল সরকার ও মৎসজীবী মালেক হোসেন জানান, বর্ষা মৌসুমে বড়াল নদীর পানি এই ক্যানেল দিয়ে স্থানীয় রামের বিল, সাঁড়োরা বিল, জবেরপুর বিলসহ পাঁচটি বিলে চলাচল করায় ফসল উৎপাদন বেশি হতো। দেশি মাছ ছিল প্রচুর। কিন্তু বর্তমানে দখল ভরাটের কারণে চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে প্রায় পাঁচ হাজার বিঘা জমির ফসল উৎপাদন। পানিশূন্য বিলে মাছ নেই। মৎসজীবীরা কষ্টে আছেন। কৃষকরা পাট জাগ দিতে পারে না পানির অভাবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বড়াল রক্ষা আন্দোলনের সদস্যসচিব এস এম মিজানুর রহমান বলেন, ‘এই ক্যানেলের অবৈধ দখল বন্ধে উপজেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে এলাকাবাসী। এ ছাড়া বাপার পক্ষ থেকে বিক্ষোভ মানববন্ধন সমাবেশ করেছি। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। কীভাবে দখলদাররা এখনো বহাল তবিয়তে আছে, কেউ বুঝতে পারছে না।’
তবে সীমানা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেদুয়ানুল হালিম। তিনি বলেন, প্রথমে ক্যানেলের সীমানা চিহ্নিত করতে হবে। ক্যানেলের জায়গা কতটুকু, ব্যক্তির জায়গা কতটুকু, তা নির্দিষ্ট নয়। তাই ক্যানেলের সীমানা চিহ্নিত করার কাজ চলছে। সীমানা চিহ্নিত করা শেষ হলে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ক্যানেল অবৈধ দখলমুক্ত করা হবে।