১২ অক্টোবর ২০২৪, ১১:০৮

রিকশায় ঝুলে থাকা মরদেহের পেছনের যে বীভৎস বর্ণনা দিলেন চালক

নিহত নাফিস  © সংগৃহীত

এক পাশে শূন্যে ঝুলছে দেশের পতাকা মোড়ানো মাথা অন্যপাশে ঝুলছে গুলিবিদ্ধ নিথর পা দুটো। একজন রিকশাচালক প্যাডেল চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দেহটি। হৃদয়বিদারক এ দৃশ্য দেখে যে কারোর পক্ষেই চোখের পানি আটকে রাখা কঠিন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বেশ ভাইরাল হয় এ ছবিটি। এতে যার দেহ পরে থাকতে দেখা যায় তার নাম নাফিস। বয়স মাত্র ১৭ বছর। সবেমাত্র বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাশ করেন।

জানা যায়, ৪ আগস্ট সকালে নাফিস শাহবাগ হয়ে ফার্মগেটে মুভমেন্টে যোগ দেয়। দুপুর দেড়টার দিকে সর্বশেষ তার মাকে কল দিয়ে জানায় সে নিরাপদে আছে। মা তাকে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে বলে। এরপর সময় গড়াতে থাকে, নাফিসের আর কোনো সন্ধান পাচ্ছিল না তার মা। মোবাইলেও কোনোভাবে সংযোগ করতে পারছিল না। সন্ধ্যা নাগাদ তার বাবা বের হয় ছেলের খোঁজে। শাহবাগ থেকে ফার্মগেট, হাসপাতাল টু হাসপাতাল খোঁজাখুজি করে কোথাও ছেলের সন্ধান না পেয়ে রাত বারোটায় ফিরে যান বাসায়। এরমধ্যে নাফিসের সেই হৃদয়বিদারক ছবি ফেসবুক ভাইরাল হয়ে যায়। বড় ভাই সেই ছবি দেখায় বাবাকে। সেখান থেকে তারা শনাক্ত করতে পারে নাফিসকে। পরবর্তীতে বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে খোঁজাখুঁজি করে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত নাফিসের বাবা মানবজমিন পত্রিকার অফিসে ছুটে যান সেই ছবিটির ফটোগ্রাফারের কাছে৷ মানবজমিনের অফিসে থাকা অবস্থায় তার শালা (মানে নাফিসের মামা) কল দিয়ে জানায় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের মর্গে পাওয়া গেছে নাফিসের লাশ।

সেদিন নাফিসের সাথে সেদিন কী ঘটেছিল সে বিষয়ে সম্প্রতি বর্ণনা দিয়েছেন ওই রিকশাচালক মো. নূর মোহাম্মদ। তিনিই নাফিসকে পুলিশের কাছ থেকে উদ্ধার করে বাঁচাতে হাসপাতালে নিয়ে যান। 

তিনি বলেন, সেদিন ধানমন্ডি ২৭ এ যাত্রী নামিয়ে দিয়ে সংসদের সামনের দিয়ে ফার্মগেটের দিকে যাচ্ছিলেন, বিজয় সরণির দিকের রোডে সংসদের কোণায় দেখেন মারামারি, তখন রং সাইড দিয়ে পাশ কাটিয়ে ফার্মগেট চলে যান। এরমধ্যে একজন যাত্রী তুলেন মগবাজারের। ফার্মগেট পুলিশ বক্স পার হবেন তখন দেখছেন বৃষ্টির মত গোলাগুলি চলছে। বিজ্ঞান কলেজের সামনে পুলিশ গতিরোধ করে উনাকে, টানেন সামনে নিতে। উনি তখন বলেন, ‘ঐদিকে গোলাগুলি হইতেছে যামু ক্যান।’ পুলিশ ধমক দিয়ে বলে, ‘তোরে আইতে কইছি আয়।’ এই বলে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। তিনি তখন, ‘দোয়াদরুদ পড়তে থাকেন। কপালে তার কী আছে আল্লাহ জানে।’ সামনে নেওয়ার পর বলে, ‘এইডা তোল রিকশায়।’ মো. নুর মোহাম্মদ (রিকশাচালক) বলেন, ‘কী তোলমু?’ তখন পাশে প্লাস্টিকের কিছু একটা আর একটা টুকরি দেখতে পান, বলেন ‘এগুলো তোলমু?’ তখন তিনি খেয়াল করেননি পাশে একটা গুলিবিদ্ধ দেহ কুণ্ডলি পাকিয়ে পরে আছে। 

পুলিশ তাকে ধমক দিয়ে বলে, ‘আরে বেটা লাশ পালাই রাখছি দেখছ না! এই যে, এইডা তোল।’ গালাগালি শুরু করে পুলিশ। 
নূর মোহাম্মদ তখন নাফিসের পেছনের সাইড ধরে উঠায়। পুলিশ তার দুই পা ধরে ধাক্কা মেরে রিকশার পাদানিতে ফেলায়। 
গাড়িতে ফালানোর পর পুলিশ বলে, ‘আরও দুইটা গুলি কইরা দে। বাইচ্চ্যা যাইতে পারে।’ রিকশার ড্রাইভারকে দেখিয়ে গালাগালি করে বলে, ‘ওই শালার পায়েও গুলি মার।’ 

রিকশা টান দিতে গিয়ে নুর মোহাম্মদ দেখেন নাফিস পরে যাচ্ছে। তখন পাশের আরেকজন পুলিশ এসে বলে সোয়া তারে। রিকশা চালক তখন দেখেন হাতটা চেইনে আটকে যাচ্ছে, তাই হাতটা টেনে রডের সাথে ঝুলিয়ে রাখে। তিনি আল রাজি মেডিকেলে নিতে চেষ্টা করে। তখনও নাফিসকে বাঁচানো যেত হয়ত। কিন্তু পুলিশ গালাগালি করে বলে, ‘বেটা এইডা সোহরাওয়ার্দী বা ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে ফালা।’ পুলিশের বাঁধা উপেক্ষা করেও আল রাজির দিকে টানে রিকশাচালক। তখন কেউ ধরতে আসেনি। ছাত্রলীগ-যুবলীগের বাঁধার মুখে সেখান থেকে ফিরে আবার চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে সেনাবাহিনী দেখে এগিয়ে আসে। বলে তাকে ইমার্জেন্সিতে নিতে হবে। দুই তিনজন তাকে ধরাধরি করে একটা অটোতে তুলে সোহরাওয়ার্দী নিয়ে যাওয়া হয়। ততক্ষণে  নাফিসে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে নেয়। 

রিকশাচালকের ভাষ্যমতে, পুলিশ প্রথমে চেষ্টা করছিল তাকে টুকরিতে করে ম্যানহোলে ফেলে দিতে তবে আশপাশে  কোথাও ম্যানহোলের ঢাকনা খুঁজে দেখতে পায়নি তারা। পরে তাকে পুড়িয়ে ফেলার কাথাও বলা হয়। তখন রিকশাচালক পাশেই দাঁড়ানো। রিকশায় যখন তুলছিল তখন যে সাংবাদিক ছবি তুলছিল তাকেও গালাগালি করে পুলিশ বলতে থাকে, ‘ক্যামরা বন্ধ কর। তোর ক্যামরা ম্যামরাসহ তোরে পুড়া দিয়ে লামু।’