ডান পায়ে গুলি নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে নূপুরকে
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গিয়ে দুই পায়ে চারটি গুলি লাগে নূপুরের। বাঁ পায়ে ৩টি, ডান পায়ে ১টি। বাঁ পায়ের ৩টি গুলি বের করা হলেও ডান পায়ের গুলিটি বের করা হয়নি। চিকিৎসক বলেছেন, ডান পায়ের গুলি বের করতে হলে পা কাটা হতে পারে। এ অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন নূপুর। হাঁটতে পারছেন না। তাই হুইল চেয়ারই এখন তার শেষ ভরসা।
নূপুরের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বাউফল ইউনিয়নের কাগজীপুর গ্রামে। পাঁচ বছর বয়সে হারান বাবাকে। মায়ের অন্যত্র বিয়ে হয়। বড় হয়েছেন নানা-নানির কাছে। বয়স যখন ১৩, তখন তারাও মারা যান। তারপর নিকটাত্মীয়ের কাছে থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। এরপর নেমে পড়েন জীবনযুদ্ধে। মিরপুরে চন্দ্রবিন্দু নামে একটি শো রুমে চাকরি নেন।
আরও পড়ুন: ‘আপনাদের তালা আমি ভেঙে দেব, তবে আমাদের বাঁচাতে হবে’
এই যখন অবস্থা নূপরের, ফলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তখন ওষুধ কিনে খাওয়া এবং উন্নত চিকিৎসা করানো তার কাছে সুদূর পরাহত এক স্বপ্ন।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে কথোপকথনে সেই আন্দোলনের রোমহর্ষক বর্ণনা এবং বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসা পরিস্থিতির বিষয়ে বলেন নূপুর।
তিনি বলেন, সারা দেশে যখন ছাত্ররা আন্দোলনে নামে, তখন ভেবেছিলাম এটা তাদের অধিকারের জন্য লড়াই করছে। কিন্তু পরে যখন পুলিশ ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো শুরু করে, তখন আমার মনেও আঘাত লাগে। আমি প্রথম ১৮ জুলাই আন্দোলনে যোগ দিই। প্রতিদিন যেতে পারতাম না কারণ আমি চাকরি করি, ছুটি পেতাম না। তবু অফিস শেষ করে আন্দোলনে যেতাম আবার যেদিন বন্ধ থাকত সেদিন যেতাম।
এদিকে ছাত্র-জনতার উল্লাস, অন্যদিকে পুলিশের গুলিবর্ষণ। হঠাৎ মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েন নূপুর, ৫ আগস্ট যখন সরকার পতনের খবর ছড়িয়ে পড়ে, আনন্দ-উল্লাস করতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে মানুষ। আমিও আনন্দ মিছিলে যোগ দিই। মিরপুর ২ এলাকায় তখনো পুলিশ গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখি গুলিতে আমার পাশের একটি ছেলের এক পা ছিঁড়ে যায়। সেখানেই সে মারা যায়। সামনে তাকাতেই আমার বাঁ পায়ে পরপর তিনটি গুলি এসে লাগে। আমি মাটিতে পড়ে যাই। উঠে দাঁড়াতেই ডান পায়ে আরেকটি গুলি লাগে। এরপর আমি আর কিছু বলতে পারব না।
নিজেকে দেখতে পান হাসপাতালে জানিয়ে নূপুর বলেন, মিরপুর হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে আমাকে ভর্তি করা হয়। সেখানে বাঁ পায়ের তিনটি গুলি অপসারণ করা হয়। তারপর অ্যাম্বুলেন্সে করে আমাকে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। ৬ আগস্ট ক্ষতস্থানগুলোয় ড্রেসিং করে এবং কিছু ওষুধ দিয়ে আমাকে রিলিজ দিয়ে দেয়। আমি বাসায় চলে যাই। স্থানীয় ফার্মেসিতে প্রতিদিন ড্রেসিং করি। কিন্তু উন্নতি হয়নি। পরে ১৯ আগস্ট আমি আবার পঙ্গু হাসপাতালে গেলে আমাকে আবার ভর্তি করায়।
আরও পড়ুন: ‘মাথা-বুক রক্তে ভিজে যায়, বাঁ চোখ চেপে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি’
তিনি বলেন, এর ফাঁকে আমার চাকরিটা চলে যায়। আমি কল দিয়ে জানতে পারি আমার যায়গায় অন্য লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে অফিস থেকে চিকিৎসার জন্য আমাকে কিছু টাকা সহায়তা করা হয়েছে। এ মুহূর্তে কী করব, কোথায় যাব, ভেবে পাই না কিছু। আমি আগের মতো হাঁটতে পারব কি না, তাও জানি না। ডাক্তার বলেছে ওষুধ খেলে আস্তে আস্তে সুস্থ হব। মাঝে মাঝে পা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাঁটার চেষ্টা করি, পুরোপুরি পারি না।
আপনার বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কী জানিয়েছে, এমন প্রশ্নে উত্তরে নুপূর বলেন, দুদিন আগে এক ডাক্তার রাউন্ড দিতে এসে আমাকে দেখে বাসায় চলে যেতে বলেছেন। আমি তখন বলেছি সরকার আমার চিকিৎসার ভার নিয়েছে। সুস্থ না হলে আমি যাব কেন? পরে ক্যাজুয়াল্টি বিভাগের চিকিৎসক ডা. জাহাঙ্গীর স্যার এসে আমার কাছে তার হয়ে ক্ষমা চেয়েছেন। এখন আমি আগামী রোববার বাসায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
এরপর কী করবেন, জানতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নূপুর বলেন, আমার কিছুই নেই। আমি অনাথ-এতিম। আগে তো চাকরি করে চলতাম। এখন দেশের জন্য আন্দোলনে গিয়ে আজ এই অবস্থা আমার। কোথায় যাব, কী করব, কিছুই জানি না। হাসপাতালে আসার পর ছাত্র সমন্বয়করা তালিকা করেছেন। সেখানে আমার নাম-ঠিকানা নিয়েছেন তারা। শুনেছি সরকারের কাছ থেকে সহায়তা পাব। এখন এসব নিয়ে কিছুই শুনি না। ‘আন্দোলনে আহত’ নামে হোয়াটসঅ্যাপ একটি গ্রুপে আমাকে যুক্ত করা হয়েছে। ওখানে কিছু ভাই-বোনের সঙ্গে কথা হয়।
আরও পড়ুন: শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি দেখে বেরিয়ে পড়েন রিকশাচালক ইসমাইল, ফিরলেন লাশ হয়ে
সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়ে নূপুর বলেন, সরকার যেন আমাদের স্মরণ রাখে। কারণ আমাদের এ অবস্থার কারণে তারা আজ সরকারে আছেন। আমাদের ভুলে গেলে আমরা কষ্ট পাব। আমি এতিম একটা মেয়ে। আমার কী চাওয়া থাকতে পারে? শুধু আপনাদের দোয়া চাই যেন একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারি।