আন্দোলনে বাবার মৃত্যুর পর সন্তানের জন্ম—নাম ‘স্বাধীন’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ২০ জুলাই (শনিবার) দুপুরে রায়েরবাগ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন আরিফ। পরে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। আরিফের মৃত্যুর প্রায় ১ মাস পর গত ১৮ আগস্ট তার স্ত্রী ছেলে সন্তানের জন্ম দেন। ছেলের জন্মের পর এলাকার সবাই ছেলের নাম রাখে ‘স্বাধীন’।
সেদিন আরিফের মৃত্যুর পর অটোরিকশা দিয়ে লাশ নিয়ে আসা হয় তার বাসায়। এলাকাবাসী পরে আবার তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে রবিবার রাত ১টার দিকে লাশ দাফন করা হয়।
মাতুয়াইল কবরস্থানের পিছনে গোবিন্দপুরে (বাক্কার মোড়) এলাকায় থাকতেন আরিফের মা ও স্ত্রী সানিয়া আক্তার। এবারের টানা বৃষ্টিতে তাদের ভাড়া ঘরে পানি ওঠায় সেটাও ছাড়তে হয়।
থাকার আশ্রয়ে একেক দিন একেক বাসায় অবস্থান করছে জানিয়ে আরিফের মা সূর্যা বানু বলেন, ‘এখন আমাদের নিজস্ব কোনো ঠিকানা নাই। একেক দিন একেক জনের বাসায় অবস্থান করতে হচ্ছে। খাবারের জন্য মানুষের বাসায় গিয়ে হাত পাততে হয়। আমার পোলাডা রিকশা চালাইত। যা আয় রোজগার করতে পাইত, তা দিয়ে আমার চিকিৎসা আর তিন জনের সংসারের খরচ চলত।’
সূর্যা বানু বলেন, ‘পটুয়াখালীর দশমিনা আমাদের বাড়ি। সেখানে কোনো জায়গা জমি নেই। ৩০ বছর আগে এই যাত্রাবাড়ী এলাকায় আসি। আরিফের বাবা সবুজ আলি রিকশা চালাইত, আমি ইট ভাঙ্গার কাজ করতাম। আমার স্বামী ১০ বছর আগে মারা গেছেন। আমি ইট ভেঙ্গে যা পাইতাম তা দিয়ে সংসার চলত। গত ৭-৮ বছর যাবৎ ইট ভাঙার তেমন কাজ নাই। কারণ মেশিন দিয়েই এখন ইট ভাঙায় সবাই।’
আরিফের স্ত্রী সানিয়া আক্তার বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আরিফ নিহত হয় ২০ জুলাই শনিবার। এই মাসেই আমার বাচ্চা হওয়া তারিখ দিয়েছিল ছিল চিকিৎসকরা। আরিফের কবর দেওয়া হয় মাতুয়াইল কবরস্থানে। কবর দেওয়ার তিন দিন পরে সবার পরামর্শে আমি বাপের বাড়ি পটুয়াখালীর দশমিনা চলে যায়। সেখানে গিয়ে আমার আমার আত্মীয়-স্বজন সাহায্য তুলে টাকা জোগাড় করে আমাকে পটুয়াখালী সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। পরে ১৮ আগস্ট সিজারের মাধ্যমে একটা ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। সেখানে এক দেড় মাসে ৫০-৬০ হাজার টাকার খরচ হয়। আমরা নিঃস্ব। আল্লাহ ছাড়া আমাদের আর দেখার কেউ রইল না।’
আরিফের স্ত্রী সানিয়া আক্তার আরও বলেন, ‘আমাদের বিয়ে হয় পাঁচ বছর আগে। সন্তান হয় না, হয় না। আল্লাহ যাও একটা সন্তান দিলেন কিন্তু সন্তানের বাবাকে কেড়ে নিলেন। আমি তো এটা চাইনি। আমি তো স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করতে চাইছিলাম। সেই সুখ আমার কপালে সইল না। ছেলের বাবা যাদের কারণে শহীদ হলো তাদের কেউ দেখতে আসে না। আমার কীভাবে চলছি। আমরা কি, আমার ছেলেকে নিয়ে দু'মুঠো ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে পারব।’
আরিফের মামাতো ভাই সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আরিফ রিকশা চালাইত, প্রতিদিনের মতো সেদিনও রিকশা নিয়ে বের হয়েছিল। কিন্তু তার আর বাড়ি ফেরা হলো না। আমরা শুনছি সে দিন সাড়ে ১২টার দিকে গুলি লাগে। গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। আমরা সেখান থেকে (মর্গ) পরের দিন রাত দেড়টার সময় লাশ পাই।’
আরিফের মা সূর্যা বানু বলেন, ‘আমরা এখনো সরকারিভাবে কোনো অনুদান পায়নি। শুধুমাত্র জামায়াতের ৫০ হাজার টাকা পেয়েছি। এই টাকা দিয়ে গত কয়েক মাসে যে ধার-দেনা হয়েছিল সেটা পরিশোধ করেছি। এখন আমাদের হাতে কোনো টাকা-পয়সা নেই। আমরা ভবঘুরের মতো জীবন যাপন করছি।’