পলাতক তালিকার শীর্ষে ডিবি হারুন, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ১৮৭ পুলিশ কর্মকর্তা
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর আত্মগোপনে গেছেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য (এমপি), দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাসহ পুলিশের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর এখন পর্যন্ত পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছাড়াও বিভিন্ন স্তরের পুলিশ সদস্যসহ ১৮৭ জন লাপাত্তা রয়েছেন। পুলিশের পলাতক কর্মকর্তাদের তালিকায় শীর্ষে আছেন ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার ডিআইজি হারুন অর রশীদ।
গত ৫ আগস্টের পর এরা আর কর্মস্থলে ফেরেননি ১৮৭ পুলিশ সদস্য। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা আর চাকরিতে ফিরতে পারবেন না। বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়াসহ এদের অনেকের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে দায়ের হওয়া ফৌজদারি মামলার তদন্ত ও বিচারকাজ আইন অনুযায়ী চলবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র দেশের এক শীর্ষ স্থানীয় গণমাধ্যমকে এমন তথ্য জানিয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, পুলিশের যেসব প্রভাবশালী কর্মকর্তাকে ইতোমধ্যে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে তারাও পলাতক। তবে পলাতক হাসিনা সরকারের অন্যতম দোসর হিসাবে চিহ্নিত প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তারা এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। পলাতকের ১৮৭ জনের এই তালিকায় ৫ জন ইন্সপেক্টরও আছেন। এ ছাড়া ১৪ জন এসআই, ৯ জন এএসআই, ৭ জন নায়েক এবং ১৩২ জন কনস্টেবল রয়েছেন। এই কনস্টেবলদের মধ্যে দুজন নারী সদস্যও আছেন।
তথ্য অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, পুলিশের পলাতক কর্মকর্তাদের তালিকায় শীর্ষে আছেন ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিবির সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদ। এখনো চাকরিচ্যুত নন পুলিশ সদর দপ্তরের এই তালিকায় তাকে এক নম্বরে রাখা হয়েছে। ৫ আগস্টের আগে-পরে সংগঠিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে হতাহতের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় আসামির তালিকায়ও তিনি শীর্ষে।
এসব মামলার মধ্যে ২০১১ সালে যে ঘটনাকে কেন্দ্র এই কর্মকর্তা লাইমলাইটে আসেন সেই তৎকালীন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ বিএনপি নেতা জয়নাল আবদিন ফারুককে নির্যাতনের মামলাও আছে। জয়নাল আবদিন ফারুক নিজেই বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। এ পর্যন্ত আলোচিত এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ৩৮ মামলায় তার নাম পাওয়া গেছে। সর্বশেষ এই কর্মকর্তা ডিএমপি ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হিসাবে বেশ সমালোচিত হন। ৫ আগস্টের পর থেকে তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না।
পলাতক পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বিতীয় সারিতে আছেন ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার। ছাত্র-জনতাসহ নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২৭টি। ৫ আগস্টের পর তাকেও আর পাওয়া যায়নি। আলোচিত-সমালোচিত এই কর্মকর্তা কর্মস্থলে আর যোগদান করেননি। ২০১১ সালে তৎকালীন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নাল আবদিন ফারুককে সংসদ ভবনের সামনে মারধরের ঘটনা ভাইরাল হলে তিনি বিগত সরকারের গুডবুকে চলে আসেন।
ওই সময় তেজগাঁও জোনের এডিসি ছিলেন বিপ্লব সরকার। এরপর আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। দফায় দফায় পদোন্নতিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চাকরি করার সুযোগ পেয়ে যান। যে কজন পুলিশ কর্মকর্তা সরকারের শীর্ষে অবস্থান করছিলেন তাদের মধ্যে বিপ্লব সরকার অন্যতম। প্রায় ১৩ বছর পর সেই জয়নাল আবদিন ফারুককে মারধরের ঘটনায় আলোচিত সেই হারুন-বিপ্লব জুটির মামলাটি করেন জয়নুল আবদিন ফারুক নিজেই।
এছাড়াও কর্মস্থলে যাচ্ছেন না অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ার্দার, অতিরিক্ত ডিআইজি খন্দকার নুরুন্নবী, অতিরিক্ত ডিআইজি এসএম মেহেদী হাসান ও অতিরিক্ত ডিআইজি সঞ্জিত কুমার রায়। যাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ৫ আগস্টের আগে-পরে সংঘটিত হতাহতের ঘটনায় একাধিক মামলা করা হয়েছে। অসুস্থতার আবেদন করে কর্মস্থলে যাচ্ছেন না অতিরিক্ত ডিআইজি উত্তম কুমার পাল, এসপি আবু মারুফ হোসেন, শাহ নুর আলম পাটোয়ারী, র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রওশানুল হক সৈকত, এএসপি মফিজুর রহমান পলাশ, এএসপি আরিফুজ্জামান, এএসপি আল ইমরান হোসেন, এএসপি ইফতেখার মাহমুদ। চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন বহুল আলোচিত আরেক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মনিরুজ্জামান।
আরও পড়ুন: আসাদুজ্জামান খান, নানক ও নাছিম দেশ ছেড়েছেন
এএসপি মি. জন রানা ৫ আগস্টের আগেই চাকরি ছেড়ে দেয়ার তথ্য জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। তিনি ২ আগস্ট পুলিশের চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। রংপুর ডিআইজি কার্যালয় থেকে সেটি পুলিশ সদর দপ্তর হয়ে ২৮ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠানো হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশের যে অবনতি হয়েছে স্বাধীনতার ৫১ বছরের ইতিহাসে এটা নজিরবিহীন। শুধু তাই নয়, চরম ইমেজ সংকটেও পড়েছে এই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রায় দেড় মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও দেশের কোথাও এখন আর আইনি ব্যবস্থা নেয়ার মতো সক্ষমতা পুলিশ গড়ে তুলতে পারেনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতে যেভাবে নির্বিচারে ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে এর সব দায় এখন পুলিশের সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর পড়েছে।
এদিকে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর গোপনে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশ ছেড়েছে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম।
দেশত্যাগের জন্য কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী ছাড়া অধিকাংশ ব্যক্তি ভারত সীমান্ত বেছে নিয়েছেন। তারা যশোর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, সিলেট, দিনাজপুরের হিলি ও পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা সীমান্ত ব্যবহার করেছেন। যাঁরা পালিয়ে গেছেন বা পালানোর চেষ্টায় আছেন, তাঁদের প্রায় সবাই হত্যাসহ বিভিন্ন মামলার আসামি।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমসহ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের আরও বেশ কয়েকজন নেতার দেশ ছাড়ার গুঞ্জন রয়েছে। তবে তাঁদের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।