১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪:২৮

‘অন্তবর্তী সরকারের সামনে তিনটি পথ খোলা’

সোসাইটি ফর ডেমোক্রেটিক রাইটসের সংবাদ সম্মেলন  © ডেইলি ক্যাম্পাস

গত ১৫ বছরে পতিত স্বৈরশাসক নিজে ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে ও চূড়ান্ত কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠতে সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে এসেছিল, যে একজন নাগরিক চাইলেও সংবিধান সঠিকভাবে অনুসরণ করে চলতে পারেন না।

বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘সংবিধান ও বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন বক্তারা। এটি আয়োজন করে সোসাইটি ফর ডেমোক্রেটিক রাইটস।

তারা বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও দায়িত্ব নিয়ে পড়েছে বেশ ঝামেলা ও গ্যাঁড়াকলে। তাদের ক্ষমতা নেওয়াটা সংবিধানের কোনও বিধান প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন করে না। তারাও সংবিধানের কিছু অংশ মানছে আবার অন্য অংশ কিংবা বহু অংশ মানতে পারছে না।

সংবিধানের আজগুবি উদাহরণ দিয়ে তারা বলেন, প্রথমত, ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ না ভেঙে নির্বাচন করা যাবে যা সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে বিরল ও নজিরবিহীন এবং একসঙ্গে ৩০০+৩০০ মোট ৬০০ এমপি স্বল্প সময়ের জন্য হলেও নির্বাচিত থাকেন একসঙ্গে। এই বিধানের প্র্যাকটিস পতিত সরকার করেছে। দ্বিতীয়ত, ৭ক অনুচ্ছেদে সংবিধান বাতিল, রদ, ষড়যন্ত্র ও সর্বোচ্চ শাস্তির কথা এমনভাবে লিখে সন্নিবেশিত করা হয়েছে যে পতিত সরকার বা তাদের কোনও দোসর যদি কোনোভাবে ক্ষমতায় আসতে পারে, তাহলে বর্তমান সরকারের সবার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে পারবে। তৃতীয়ত, ৫৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু স্পিকার যদি অসমর্থ বা অনুপস্থিত হন, তাহলে কে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন, বিষয়টি সংবিধান অনুধাবন করেনি। চতুর্থত, ৪৭ অনুচ্ছেদে অনেক বিধান আছে যা সরাসরি মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত সংবিধানের অন্যান্য অনুচ্ছেদের সরাসরি বিপরীত ও সাংঘর্ষিক। পঞ্চমত, সংবিধানের ৭থ অনুচ্ছেদ সংবিধানের সিংহভাগ সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণ অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। সংবিধানের দ্বন্দ্ব ও অসংগতির ব্যাপারে আরও বহু উদাহরণ দেওয়া যাবে।

তারা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ও শ্রেষ্ঠ গণ-অভ্যুত্থান থেকে জন্ম নেওয়া বর্তমান সরকারকে সংবিধান নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করার সময় এসেছে। আশার কথা যে সরকার এ সম্পর্কে গতকাল ড. শাহদীন মালিককে চেয়ার করে একটি কমিশন আমরা এটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখতে চাই। গঠন করেছেন।

সংবিধান নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে তিনটি পথ খোলা
আলোচকরা বলেন, প্রথমত, ১৫ বছরে কাটাছেঁড়া করা সংবিধান ভেঙে সম্পূর্ণ নতুন একটি সংবিধান জাতিকে আসনে উপহার দেওয়া। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের মাধ্যমে ৩০০ আসনে এমপি নির্বাচিত করে সংসদ গঠন করা। এটির একমাত্র ও সবল কাজ হবে সংবিধান রচনা ও গৃহীত করা। তৃতীয়ত, অন্তবর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ, স্থায়িত্ব ও চলমান কাজের বৈধতার জন্য একসঙ্গে গণভোটের আয়োজন ও করা যেতে পারে।

তারা আরও বলেন, আমাদের সংবিধানের শুরু ও যাত্রা ছিল গলদপূর্ণ। ১৯৭২ সালের সংবিধানকে গ্রহণের জন্য ১৯৭০ সালের পাকিস্তান আমলের এলএফওর অধীনে নির্বাচিত এমপি দ্বারা গঠন করা হয়। এখন প্রশ্ন হলো, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে খোদ পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হওয়া দেশের সংবিধান রচনা ও অনুমোদন সেই পাকিস্তানের সংবিধান ও এলএফওরে অধীনে নির্বাচিত এমপিরা করেন কীভাবে? এই যৌক্তিক প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন বাংলাদেশের সাবেক মেধাবী প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল তার মৃত্যুর কয়েক বছর আগে ঢাকার এক সেমিনারে।

গণভোটের বিষয়ে তারা বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ, স্থায়িত্ব ও চলমান কাজের বৈধতার জন্য গণভোটের আয়োজনও করা যেতে পারে, যেভাবে ব্রিটেনে এক দিনে একাধিক নির্বাচন হয়। ১/১১ সরকারের মতো এই সরকার পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের ওপর নির্ভর করবে। অর্থাৎ ১/১১ সরকারের মতো যত দিন থাকবে, পরবর্তী সরকার এসে কার্যাবলি তাদের মেয়াদ, চলমান সংবিধান পরিবর্তনের বৈধতা দেবে।

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর সফল গণ-অভূত্থানের মাধ্যমে আসা জাতির জন্য এমন সুযোগ আর নাও আসতে পারে। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জাতিকে নতুন একটি সংবিধান উপহার দেওয়া সময়ের দাবি। নতুন সংবিধান রচনা করা তো দূরের কথা, রাজনৈতিক সরকার তাদের স্বার্থ ছাড়া সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তনে হাত দেবে না। কারণ গত ৫৩ বছরে সংবিধানকে ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে। এর বেশিরভাগই করা হয়েছে ব্যক্তি, দলীয় ও নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে। অপরদিকে অনেক সময় রাজনৈতিক সরকারের ইচ্ছা ও প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও আমলাদের প্রচণ্ড চাপে সরকার সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন করতে পারে না ৷

তারা বলেন, জাতি সংবিধান নিয়ে অনেকটা ধোঁয়াশার মধ্যে আছে। এই ধোঁয়াশাই সৃষ্টি করে গুজব, কানকথা ও উৎকণ্ঠা। যে যা-ই বলুক, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রকে মেরামত ও দেশকে অবারিত সম্ভাবনার পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের দরকার নতুন, যুগোপযোগী আধুনিক ও গতিশীল সংবিধান।