০৭ আগস্ট ২০২৪, ২০:১০

ধানমন্ডি-৩২: বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত সেই ভবন আর এই ভবন

৩২ নম্বর রোডের বাড়ি  © টিডিসি ফটো

চারদিকে উৎকট গন্ধ। পুড়ে গেছে দেয়ালগুলো। ভেতরে ধ্বংসস্তূপ আর ভাঙা কাঁচের টুকরো। দেখে মনে হবে যেন প্রাচীন পরিত্যক্ত কোনো পোড়াবাড়ি কিংবা জনবসতিহীন ভুতুড়ে প্রাঙ্গণ। অথচ এটিই বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত ধানমন্ডির সেই ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর রোডের ৬৭৭ নম্বর বাড়ির চিত্র। যার পরিবর্তিত বর্তমান ঠিকানা ১০ নম্বর বাড়ি, রোড নম্বর-১১, ধানমন্ডি-ঢাকা। বাড়ির প্রতিটি কামরা শূন্য থাকলেও পোড়া গন্ধে এখনও ভারি হয়ে আছে বাতাস। শুধু বঙ্গবন্ধুর বাড়িই নয়, আশেপাশের বাড়িগুলোও বেশিরভাগ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। 

বুধবার (০৭ আগস্ট) সকালে সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, কিছুই সেখানে অক্ষত নেই। প্রতিটি দরজা-জানালা, আসবাবপত্র এমনকি বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচিহ্ন— কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই সেখানে। গত সোমবার (৫ আগস্ট) ছাত্র-জনতার অসহযোগ আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর বাড়িটি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের কবলে পড়ে। শিক্ষার্থীরা জানান, এই ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে।

বাড়ির ভিতরে ক্ষতিগ্রস্ত কক্ষের দৃশ্য

সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, পুড়ে যাওয়া বাড়িটির লাইব্রেরিতে থাকা কয়েক হাজার বই পুড়ে গেছে। অবশিষ্ট নেই কোনো আসবাবপত্র কিংবা সরঞ্জাম। গতকাল মঙ্গলবারেও লুটপাট হয় অনেক মূল্যবান জিনিস। এখনও বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ বাড়িটি দেখতে এসে অবশিষ্ট যা পাচ্ছেন তাই নিয়ে পালানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। বুধবার সকালে শিক্ষার্থীরা উদ্যোগী হয়ে বাড়ি পরিষ্কারের দায়িত্ব নেন। এরমধ্যে সেনাবাহিনীর একটি টিমকেও নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকতে দেখা যায়।

সরকার পতনের দিনে হামলা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের দৃশ্য বর্ণনা করে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর এলাকার বাসিন্দা নুরুল হুদা জানান, আমি কোন রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত নয়। তবে যা ঘটেছে এটা শুধু রাষ্ট্রের ক্ষতি ছাড়া কিছুই নয়। এই বাড়িটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মারক বহন করে। আওয়ামী লীগ ২০২৪ সাল পর্যন্ত যে অন্যায়-অবিচার করেছে সেটির জন্য তাদের বিচার হতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করার কোন যৌক্তিকতা নেই। সেদিন যাদের দেখেছি তারা কেউই ছাত্র ছিল না। তারা ভিন্ন পরিচয়ের মানুষ ছিল।

বাড়ির সামনের সড়কটি পরিষ্কার করছেন স্বেচ্ছাসেবীরা

বর্তমানে বাড়িটির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতের দায়িত্ব পালন করছেন বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য এবং স্কুল, কলেজ, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব পালন করছেন এমন কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীর সাথে কথা হয়। তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরাও রয়েছেন। তারা বিভিন্ন শিফট অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করছেন। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে তারা নিজেদের ছবি প্রকাশ করতে রাজি হননি।

আমরা ধ্বংসের পক্ষে নয়, বরং নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই। যারা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন, তাদের সাথে ছাত্র সমাজের বিন্দু পরিমাণ সম্পর্ক নেই। আমরা অত্যন্ত ব্যথিত এমন দৃশ্যের জন্য। এই বাড়িটি স্বাধীনতার স্মৃতি বহন করে। তারচেয়ে বড় বিষয় হলো এই হামলা লুটপাট শুধু দেশের সম্পদ ধ্বংস করা ছাড়া কিছুই নয়। 

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী মাজহারুল জানান, আমাকে এখানে কেউ আসতে বলেনি। সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে এবং বিবেকের তাড়নায় এসেছি। আমরা ধ্বংসের পক্ষে নয়, বরং নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই। যারা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন, তাদের সাথে ছাত্র সমাজের বিন্দু পরিমাণ সম্পর্ক নেই। আমরা অত্যন্ত ব্যথিত এমন দৃশ্যের জন্য। এই বাড়িটি স্বাধীনতার স্মৃতি বহন করে। তারচেয়ে বড় বিষয় হলো এই হামলা লুটপাট শুধু দেশের সম্পদ ধ্বংস করা ছাড়া কিছুই নয়। 

স্বেচ্ছাসেবীদের সূত্রে জানা যায়, জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সহায়তায় গতকাল মঙ্গলবার লাইব্রেরি থেকে কিছু বই সরিয়ে নেয়া হয়। এর বাহিরে আর তেমন কোনো সরঞ্জাম রক্ষা করা যায়নি। দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর এই বাড়িটি বুধবার সকালে পরিদর্শন করেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। 

বাড়ির সামনের সড়কটি পরিষ্কার করছেন স্বেচ্ছাসেবীরা

এসময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনা কোনোভাবে এক কথা নয়। বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা, স্বাধীনতার মহানায়ক। আজকে ৩২’র বাড়ি যেভাবে জ্বলতে, পুড়তে ও ধ্বংস হতে দেখলাম। তার আগে আমার মৃত্যু হলে অনেক ভালো হতো। তিনি আরও বলেন, আসলে দেশে একটা বিপ্লব ঘটে গেছে। আমি ছাত্রদের এই আন্দোলনকে অভিনন্দন জানাই।

তিনি আরও যোগ করেন, নিশ্চয় আওয়ামী লীগ অন্যায় কাজ করেছে অনেক। কিন্তু শেখ মুজিব কিছু করেনি। তিনি বাঙালি জাতিকে সম্মানিত করেছেন। আজকের এই ধ্বংস, ভবিষ্যৎ ইতিহাসে বাঙালি জাতির জন্য একটা কলঙ্ক হয়ে থাকবে।

জানা যায়, ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট ৩২ নম্বরের এই বাড়িটি ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে উদ্বোধন করে তৎকালীন সরকার। এর আগে ৩২ নম্বরের বাড়ি ও টুঙ্গিপাড়ার বাড়ি দেখাশোনা করার জন্য একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। ট্রাস্টিই বাড়িটিকে জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা দেয়।