সংঘাতের ঘটনায় ঢামেকে ৭৮ লাশ, দৃষ্টি হারানোর শঙ্কায় ৮২ চোখ
দেশে চলমান কোটা বিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সংঘাত-সংঘর্ষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ৭৮ জনের মৃত্যুর রেকর্ড করেছে। তাদের কারও লাশ এসেছে হাসপাতালে, আবার কারও মৃত্যু হয়েছে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। এছাড়া আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন ১৫৫৪ জন। যাদের মধ্যে ৩৭১ জনকে ভর্তি করা হয়। আহতদের বেশির ভাগই গুলিবিদ্ধ।
গত ১৫ই জুলাই থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত সময়ের এই পরিসংখ্যান দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হতাহতদের মধ্যে শিক্ষার্থী, পথচারী, ব্যবসায়ী, রিকশা চালকসহ নানা পেশার মানুষ রয়েছেন। সংঘর্ষে মারাত্মক আহতের মধ্যে অনেকের কোনো না কোনো অঙ্গহানি হওয়ার আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকরা। আহতদের মধ্যে অনেকের চোখ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারও এক চোখ, কারও বা দুই চোখেই গুলি লেগেছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, জরুরি বিভাগ দিয়ে গত ১৫ই জুলাই থেকে গতকাল পর্যন্ত ৮ দিনে সংঘর্ষের ঘটনায় ১৫৫৪ জনের বেশি রোগী টিকিট কেটে চিকিৎসা নিয়েছেন। গুরুতর আহত অনেকে ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে। ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৩৭১ জন। তাদের মধ্যে কয়েকজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে গুলিবিদ্ধ হয়ে বা হামলায় নিহতদের লাশ আনা হয় হাসপাতালে। রাজধানীর অন্য কয়েকটি হাসপাতাল থেকেও ঢামেকে নিহত কয়েকজনের মৃতদেহ পাঠানো হয়।
আরও পড়ুন: কোটা আন্দোলন: ইন্টারনেট বন্ধে ৫ দিনে যা যা ঘটেছে
ঢাকা মেডিকেলের বাইরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিডফোর্ট) হাসপাতাল, উত্তরার কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালেও নিহতদের লাশ নেয়া হয়। চিকিৎসা নেন অনেক রোগী। বাড্ডা, মালিবাগ, উত্তরা, যাত্রাবাড়ী ও মোহাম্মদপুর এলাকার বেসরকারি হাসপাতালেও আহতরা চিকিৎসা নিয়েছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সংঘর্ষে আহত ১৫ই জুলাই জরুরি বিভাগ দিয়ে টিকিট কেটে চিকিৎসা নিয়েছেন ৩০৬ জন রোগী। এরমধ্যে গুরুতর আহত হওয়া ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ১৩ জন। ১৬ই জুলাই চিকিৎসা নিয়েছেন ১২৯ জন এবং ভর্তি হয়েছেন ৯ জন। এদিন লাশ এসেছে ২ জনের। ১৭ই জুলাই চিকিৎসা নিয়েছেন ৬৫ জন এবং ভর্তি হন ৮ জন। ১৮ই জুলাই চিকিৎসা নিয়েছেন ২৭৬ জন, ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৮৭ জন এবং মৃতের সংখ্যা ১১ জন।
গত ১৯শে জুলাই চিকিৎসা নিয়েছেন ৪৮২ জন, ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১৫৫ জন এবং মৃতের সংখ্যা ৪১ জন। ২০শে জুলাই চিকিৎসা নিয়েছেন ১৮৯ জন, ভর্তি হয়েছেন ৭৬ জন এবং লাশের সংখ্যা ১৩। ২১শে জলাই চিকিৎসা নেন ৯৩ জন, ভর্তি হয়েছেন ২০ জন এবং লাশের সংখ্যা ৯। গতকাল ২২শে জুলাই দুপুর ১টা পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছেন ১৪ জন, ভর্তি হয়েছেন ৩ জন এবং সংঘর্ষের ঘটনায় এই দিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ২ জন।
আরও পড়ুন: চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন: নিহত বেড়ে ১৯৭
সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ অনেক রোগী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে বর্তমানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে কমপক্ষে ৩৬ জনের চোখে গুলি লেগেছে। তারা চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এদের বেশির ভাগ চিরতরে চোখের আলো হারাতে পারেন বলে জানিয়েছেন চক্ষু চিকিৎসকরা।
গতকাল চক্ষু বিভাগের ওয়ার্ডে ঘুরে দেখা গেছে, ৩০১, ৩০৫, ৩০৬ ওয়ার্ডে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ রোগীরা চোখের চিকিৎসা নিচ্ছেন। এসব ওয়ার্ডের চিকিৎসক ও নার্সদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব রোগীর অধিকাংশ চোখ হারানোর শঙ্কায় আছেন। কারও এক চোখ, কারও বা দুই চোখেই গুলি লেগেছে। তাদের বেশির ভাগের চোখের কর্নিয়া নষ্ট হয়ে গেছে।
চিকিৎসাধীন বড় অংশের অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। অস্ত্রোপচারের পরও অনেকের চোখের আলো ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ। রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করেন, রোগীর চাপ থাকায় চোখে অস্ত্রোপচারের সিরিয়াল মিলছে না। অনেকে বারান্দায় শয্যা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সরা জানিয়েছেন, সংঘর্ষে আহতদের মধ্যে শিক্ষার্থী, পথচারী, ব্যবসায়ী, রিকশা চালকসহ নানা পেশার মানুষ রয়েছেন।
আরও পড়ুন: কোটা আন্দোলন: ইন্টারনেট বন্ধে ৫ দিনে যা যা ঘটেছে
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের তৃতীয় তলায় অবস্থিত চক্ষু বিভাগে গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৪১ জন রোগী; যারা সহিংসতায় মূল্যবান চোখ প্রায় হারিয়েছেন। ৪১ জনের ৮২টি চোখের মধ্যে কারও দুই চোখেই সেলাই, পুরোপুরি চোখ বন্ধ, কারও চোখ বেয়ে পুঁজ পড়ছে। কারও আবার চোখসহ মুখমণ্ডল, মাথা-বুকে গুরুতর জখম। সবার চোখেই ছররা বুলেটে গুলিবিদ্ধ। কারও চোখ রাবার বুলেটে আঘাতপ্রাপ্ত। কারোর আবার নাক, মুখ এবড়ো-খেবড়ো হয়ে আছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত ৩১ জনের বড় ধরনের অপারেশন হয়েছে।
ঢামেক হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোস্তাক আহমেদ মঙ্গলবার বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন-সহিংসতায় আহত হয়ে চক্ষু বিভাগে ৪১ জন ভর্তি রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩১ জনের অপারেশন করা হয়েছে। বাকিদের পর্যায়ক্রমে করা হবে। সবারই চোখ ছররা গুলিবিদ্ধ। খুবই জটিল অবস্থা। আমাদের চিকিৎসক স্বল্পতা রয়েছে। চিকিৎসক এনে চিকিৎসা চালানো হচ্ছে। ভর্তি হওয়াদের মধ্যে অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে। চোখ মহামূল্যবান সম্পদ। আমরা চিকিৎসা প্রদানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। অনেকের মুখ-মাথায়ও জখম রয়েছে। মুখ-মাথার সঙ্গে চোখের জখম নিশ্চয় শঙ্কার। আমরা দিন-রাত সেবা দিচ্ছি, বাকিটা সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা।