২০৩০ সালে ঢাকা শহরে স্বস্তি ফিরবে!
বসবাসযোগ্য শহর হিসেবে বিশ্বের ১৭৩টি শহরের মধ্যে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান ১৬৮। এক বছর আগের অবস্থান ছিলো ১৬৬। এক বছরে দুই ধাপ অবনতি হয়েছে এই শহরের। এই তালিকায় বিশ্বের মাত্র পাঁচটি শহরের অবস্থা ঢাকার চেয়ে খারাপ। ইকোনমিস্টের প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) বার্ষিক জরিপে ঢাকার এই অবস্থানের কথা জানা গেছে। তারা জরিপে স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামো- এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে তালিকাটি তৈরি করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকাকে বসবাসের আদর্শ শহর করার আর কোনো উপায় নেই। তবে কিছুটা স্বস্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সেটা করতে হলে পরিকল্পনা মাফিক নগর উন্নয়ন করা দরকার। দরকার সুশাসন। ঢাকা এখন জনসংখ্যার আধিক্যে ধুঁকছে। তারপরও ঢাকার জনসংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে।
সবশেষ জনশুমারি অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে রয়েছে চার কোটি ৫৬ লাখ ৪৩ হাজার ৯৯৫ জন। যা মোট জনসংখ্যার ২৬.৮৮ শতাংশ। আর ঢাকা শহরের জনসংখ্যা দুই কোটির বেশি। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাস করেন চার লাখের বেশি মানুষ।
বিশ্বে বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায়এবার নিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে ইউরোপের দেশ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা। এরপরেই রয়েছে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ।
বসবাসযোগ্য ১৭৩টি শহরের মধ্যে ঢাকার চেয়েও পিছিয়ে রয়েছে ৫টি শহর। এগুলো হচ্ছে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক, লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি, আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্স, নাইজেরিয়ার লাগোস ও পাকিস্তানের করাচি। তালিকায় ২০২১ সাল থেকে অব্যাহত ক্ষেপণাস্ত্র আর ড্রোন হামলায় বিধ্বস্ত ইউক্রেনের রাজধানী শহর কিয়েভ বাংলাদেশের ঢাকার তুলনায় তিন ধাপ ওপরে আছে। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধরত দেশটির এই রাজধানী বাসযোগ্য শহরের তালিকায় এই বছর ১৬৫তম অবস্থানে রয়েছে।
গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্সে মোট ১০০ পয়েন্ট রয়েছে। এর মধ্যে যে শহর যত বেশি পায়, তালিকায় সেটির অবস্থান তত ওপরে থাকে। সূচকে ঢাকার অবনতির প্রধান কারণ নাগরিকদের শিক্ষার পরিবেশ ও গুণগত মানের পতন। ঢাকা স্থিতিশীলতায় ৫০, স্বাস্থ্যসেবায় ৪১.৭, সংস্কৃতি ও পরিবেশে ৪০.৫, শিক্ষায় ৬৬.৭ এবং অবকাঠামোতে ২৬.৮ পয়েন্ট পেয়েছে ঢাকা।
কী হবে ঢাকা শহরের
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্স (বিআইপি) মনে করে, ঢাকায় সেবা দেওয়ার সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোর নজরদারি ও জবাবদিহিতা দুর্বল। ব্যয়বহুল উন্নয়ন প্রকল্প করা হলেও বাসযোগ্যতায় ঢাকা পিছিয়েই থাকছে। বিশেষ করে গত এক দশকে অবকাঠামো সূচকে বাংলাদেশ এক জায়গায় আটকে আছে। আগামী সময়েও বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকার অগ্রগতির সম্ভাবনা কম। তাদের কথা, ঢাকায় নাগরিক সুবিধা ও জনঘনত্বের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকার অবাসযোগ্যতা ও অস্থায়িত্বশীল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সারা দেশের জন্যই বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ও অন্যান্য আইনের কার্যকর বাস্তবায়নের অভাব রয়েছে। ঢাকায় যেসব অবকাঠামো গড়া হচ্ছে, সেগুলোও পরিকল্পনার মানদণ্ডে যথেষ্ট না। আর সুশাসন না থাকলে শুধু অবকাঠামো দিয়ে বাসযোগ্যতায় উন্নতি হবে না। বাসযোগ্য শহরে গণপরিবহন অপরিহার্য। সরকার অবকাঠামো খাতে গুরুত্ব দিলেও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে পারেনি।
বিআইপির সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান ডয়চে ভেলেকে বলেন," এই শহরে শিশুদের জন্য খেলার মাঠ নেই। তারা খোলা আকাশ দেখেনা। তাদের বিনোদনের কোনো জায়গা নেই। এই একটি মাত্র বিষয় থেকেই বোঝা যায় ঢাকা কতটা বসবাসের যোগ্য আছে। দিন দিন ঢাকা বসবাসের একটি অযোগ্য শহরে পরিণত হচ্ছে। এই শহর এখন জনআধিক্যে ভুগছে। আর প্রতিদিনই জনসংখ্যা বাড়ছে। তাই এর খুব বেশি উন্নতি সম্ভব নয়। তারপরও সঠিক পরিকল্পনা নিলে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব।”
তার কথা," এখানে অবকাঠামো হচ্ছে। সেটা পরিকল্পনামাফিক হচ্ছে বলে মনে হয়না। আর সেটা নির্মাণে পরিবেশ ও প্রতিবেশকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছেনা। এখানে এখন জলাধার ভরাট করা হচ্ছে। মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে সমস্যার সমাধান নয়। মেট্রোরেল তো শহরেরর শতকরা এক ভাগ যাত্রীও বহন করতে পারছেনা। ফলে অসহনীয় যানজটের কোনো সমাধান নাই।”
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ঢাকাকে সারাদেশের সঙ্গে মিলিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। এটাকে আলাদা দ্বীপ হিসেবে চিন্তা করলে হবেনা। সারাদেশের মানুষ তার পেশা, শিক্ষা, চিকিৎসার জন্য এই শহরে ছুটে আসছে। এত মানুষের চাপ তো এই শহর নিতে পারবেনা।
তাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ মনে করেন," ঢাকার ওপর মানুষের চাপ কমাতে হবে সবার আগে। কিন্তু তার কোনো পরিকল্পনা নাই। দেশের অন্যান্য শহরের যদি উন্নয়ন করা হয়। সেখানে যদি কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষার ভালো ব্যবস্থা করা যায় তাহলে রাজধানীর ওপর চাপ কমবে। এত লোকের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা ঢাকা শহরের পক্ষে সম্ভব নয়। তারপরও যদি ঢাকার জনসংখ্যা আরো বাড়তে থাকে তাহলে এটা পুরোপুরি বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হবে।”
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন," এই শহরে ৩০ ভাগ মানুষ বস্তিতে বসবাস করেন। তাদের স্বাস্থ্য, সেনিটেশন ব্যবস্থা খুবই খারাপ অবস্থায় আছে। শহরে নিম্নবিত্ত মানুষের সন্তানদের পড়ালেখার সুযোগ সীমিত হচ্ছে দিন দিন। গণপরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে বলা যায়। তাহলে এই শহর বাসযোগ্য হবে কীভাবে?” তার কথা," ঢাকা শহরকে বিকেন্দ্রায়ন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নাই।”
২০৩০ সালে স্বস্তি ফিরবে!
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ঢাকার গৃহায়ন ও নগর পরিল্পনার জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত। তারা এই পরিস্থিতিতে কী করছে? রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, "ঢাকা শহরকে বিকেন্দ্রায়ন করতেই হবে। এজন্য আমরা কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছি। ধাপে ধাপে এগুলো শেষ হতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত লেগে যাবে। আশা করি তখন ঢাকা শহরে একটা দৃশ্যমান পরিবর্তন আসবে। স্বস্তি ফিরে আসবে।”
তিনি জানান," রাজউক ডেনসিটি জোন গড়ে তুলছে। ঢাকার আশাপাশ মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ এবং নরসিংদী এই তিনটি জেলাকে কমিউটার রেল দিয়ে ঢাকার সঙ্গে ২০২৬ সালের মধ্যে যুক্ত করার কাজ চলছে। এটা শেষ হলে ঢাকার ওপর মানুষের চাপ কমবে। অনেকেই তখন ঢাকায় না থেকে ওইসব জেলায় থাকবেন। দিনের কাজ শেষে তারা চলে যাবেন।”
শিক্ষার জন্য রাজউকের উদ্যোগে উত্তরায় রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল ও কলেজ করা হয়েছে। আরো তিনটি স্কুল করা হচ্ছে। শহরে চারটি নতুন পার্ক করা হবে। সরকারি খাস জমিতে আরো ৫৫টি পাবলিক পার্ক ও পুকুর খননের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। তার কথায়, "তারপরও ঢাকাকে বসবাসের আরো উপযোগী করতে সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। পরিবেশ, স্বাস্থ্যসেবা, গণপরিবহনসহ আরো অনেক বিষয় আছে যা ঠিক করা রাজউকের একার পক্ষে সম্ভব নয়।”