সিলেট আরও ডুবছে, ২০২২ এর পরিণতি হবে কী?
দেশজুড়ে ঈদুল আজহার আমেজ থাকলেও আনন্দ বঞ্চিত দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিভাগ সিলেটের বাসিন্দারা। আকস্মিক বন্যায় তলিয়ে গেছে বিভাগাটির সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার সিংহভাগ এলাকা। ফলে সেখানকার লাখ লাখ মানুষের মধ্যে ঈদের আনন্দের পরিবর্তে জায়গা করে নিয়েছে আতঙ্ক।
ভারতের মেঘালয়ের ঢালে অবস্থিত সিলেট জেলায় বর্ষাকালে বন্যার ঝুঁকি থাকেই। এর মধ্যে টানা বৃষ্টিতেও অনেক সময় নগরীর সব রাস্তাঘাট তলিয়ে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়; যাতে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। গত রবিবার টানা কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে সিলেট নগরীর ১০০টি পাড়া-মহল্লার বাসা-বাড়ি জলমগ্ন হয়। এ সময় ২৪ ঘণ্টায় ২২৬.৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ডের তথ্য জানিয়েছিল আবহাওয়া কার্যালয়। এর আগে ২০২৩ সালের ১৪ জুন মাত্র ছয় ঘণ্টায় ১৫১ মিলিমিটার বৃষ্টিতেও তলিয়ে গিয়েছিল নগরীর অধিকাংশ এলাকা।
দুই বছর আগে ২০২২ সালের মে মাসে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে সিলেট অঞ্চলে শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। দুই বছর পর ঠিক একইসময়ে আরেকটি ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি তারা। এভাবে বারবার বন্যার কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা এজন্য ‘অপরিকল্পিত উন্নয়নকেই’ দায়ী করছেন।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের সিলেট ও ভারতের মেঘালয়, এই দুই এলাকায় অন্যান্য জায়গার চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় সাধারণত। সংশ্লিষ্টদের মতে, এবারও আকস্মিক বন্যার অন্যতম কারণ অস্বাভাবিক বৃষ্টির কারণে পাহাড়ি ঢল।
কারণ হিসেবে তারা আরও বলছেন, নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে পানি বহনের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়া, অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও সড়ক নির্মাণ, পাথর উত্তোলন বন্ধ , বন্যা প্রতিরোধ বাঁধে পানি উন্নয়ন কর্তাদের লুটপাট ও অনিয়ম। এসব সমস্যার দ্রুত সমাধান না হলে আগামীকে আরও ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই সিলেট অঞ্চলে বন্যা মোকাবিলায় নতুন করে প্রশাসনকে ভাবতে হবে বলে মত দিয়েছেন জনপ্রতিনিধি ও গবেষকরা।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক কৌশিক সাহা বলেন, প্রতিবছর মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বরাক উপত্যকায় অতি বৃষ্টি হয়ে থাকে। ঐতিহাসিকভাবে অতি বৃষ্টির পানি সিলেট অঞ্চলের নদী-নালা, হাওর, নিম্নাঞ্চল দিয়ে বঙ্গপোসাগরে প্রবাহিত হয়। তবে গত কয়েক বছরে নদীর গভীরতা কমে যাওয়া, জলাশয় ভরাট, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব, অপরিকল্পিত স্থাপনা তৈরিসহ বিভিন্ন কারণে এ অঞ্চলে পানি প্রবাহের স্বাভাবিক গতিপথ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও পেশাজীবীদেরকে সঙ্গে নিয়ে এই পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন এই শিক্ষক।
সুনামগঞ্জ ৫ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি মুহিবুর রহমান মানিক বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি প্রবণ এলাকা হচ্ছে ভারতের চেরাপুঞ্জি। চেরাপুঞ্জি এলাকার নিকটবর্তী হওয়ার কারণে এখানে সহজে বন্যা সৃষ্টি হয়। তবে শুধু এই কারণেই যে বারবার বন্যা হচ্ছে এমন নয় সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে, একই অবস্থা অন্যান্য নদীর ক্ষেত্রেও। ফলে উজান থেকে নেমে আসা পানিতে নদীর দুই পাড় সহজে ভরে গিয়ে বন্যা সৃষ্টি করছে। বারবার আমি এ বিষয়ে কথা বলছি কিন্তু নদী খননের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। সুরমা কুশিয়ারায় প্রতিবছর অল্প অল্প করে খনন করা হয় ফলে যেটুকু খনন করা হয় তা আবার পলিমাটি এসে ভরাট করে দিয়ে যায়। এভাবে নদী খনন করলে অর্থের অপচয় হলেও কোনো লাভ হবে না। একটা মাস্টার প্ল্যান নিয়ে নদী খননের কাজ না করলে সিলেট ও সুনামগঞ্জকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করা যাবে না। সিলেট শহর তো একদম সুরমা নদীর নিকটবর্তী। এ নিয়ে আমাদের সুপরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর-শান্তিগঞ্জ উপজেলার সংসদ সদস্য ও সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, একসঙ্গে হঠাৎ ভারত ও আমাদের অংশে বৃষ্টি হলে যেহেতু আমরা নিম্নাঞ্চলে তাই বন্যায় আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হই। আমাদের নদী নালা খনন করে তার ক্যাপাসিটি বাড়ানো আশু কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু নদী নালা খাল ভরাটের কাজ হচ্ছে না যা দুঃখজনক। আমরা হাওড় এলাকায় প্রচুর উন্নয়ন কাজ করেছি, সড়ক নির্মাণ করেছি এটা কতটা বৈজ্ঞানিক উপায়ে হয়েছে এবং এর ফলে পানির প্রবাহে কতটা বাঁধা পাচ্ছে তা নিয়েও ভাবতে হবে। সরকার ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাওড় এলাকায় নতুন করে বড় সড়ক নির্মাণ না করার।