হাতুড়ির টুংটাং শব্দে ব্যস্ত সময় যাচ্ছে কামারপাড়ায়
হাপর টেনে লোহার দণ্ড পুড়িয়ে দা-চাকু চাপাতিসহ কোরবানির সরঞ্জামাদি তৈরি করছেন নিতুন সরকার ওরফে নিত্ত কর্মকার। আর সেই পোড়ানো কঠিন পদার্থ হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে সোজা করছেন তার সামনে বসা হরিপদ ওরফে হরিৎ কর্মকার। বয়স ৭০ বছর ছুঁই ছুঁই। তিনিই এখানের প্রধান। তার ডান পাশেই আগুনের ফুলকি উড়িয়ে শাণ দেওয়ায় ব্যস্ত শিবনাথ কর্মকার। এভাবে দুই তিনজন মিলে সামাল দিচ্ছেন কামারশালার একটি দোকান।
এমনই দৃশ্যের দেখা মেলে সাভার উপজেলার পাথালিয়া ইউনিয়নের পানধোয়া এলাকায়। এলাকাটি ঢাকা আরিচা মহাসড়ক লাগোয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর সংলগ্ন এলাকায়। ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বাড়ছে কামারপাড়ার ব্যস্ততা।
সেই সাথে পবিত্র ইদুল আজহাকে কেন্দ্র করে উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নের বাসস্ট্যান্ড, বাজার ও পশুর হাটেও অস্থায়ী কামারশালা গড়ে উঠেছে। এর ফলে টুংটাং শব্দে মুখর হাট-বাজার ও রাস্তার আশপাশ।
একদিন বাদে ঈদুল আজহা। কামারশালার পাশ দিয়ে পথ অতিক্রম করলেই শোনা যায় হাতুড়ি আর লোহার টুটাং আওয়াজ। নির্ঘুম সময় পাড় করছেন কর্মকাররা। কোরবানির পশু জবাই ও মাংস তৈরিতে চাকু, চাপাতি, দা, বঁটি, আবশ্যকীয়। কোরবানির আগে এসব উপকরণ হাতের কাছে না থাকলেই নয়। সেগুলো সংগ্রহ ও প্রস্তুত করতে এখন ব্যস্ত সবাই।
এসব উপকরণ তৈরি ও শাণ দেওয়ার জন্য কামারশালায় দৌড়ঝাঁপ পাড়ছেন ক্রেতারাও। ক্রেতা সামলাতে কামারশালার লোকজন ভীষণ ব্যস্ত। যেন দম ফেলার ফুরসত নেই তাদের!
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সাভার ও আশুলিয়ার বাজারগুলোর মোড়ে মোড়ে এবং পশুর হাটে এখন ব্যস্ততা। সর্বক্ষণ বাতাসে ভাসছে ঠুংঠাং শব্দ। কথা বলার সময় নেই কারও। কেউ হাপর টানছেন। কেউবা আগুনে কয়লা দিচ্ছেন। জ্বলন্ত আগুনের চুলা থেকে লোহা তুলে সমানতালে পেটাচ্ছেন তারা। সেই পেটানো তপ্ত লোহা থেকে তৈরি করছেন দা, বঁটি, ছুরি, চাপাতিসহ কোরবানির সরঞ্জামাদি।
এক কেজি ওজনের একটি চাপাতি তৈরির দাম ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। দা ও বটি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। পশুর চামড়া ছাড়ানোর জন্য ছোট আকারের চাকুর দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। জবাইয়ের ছুরি ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। এছাড়া মানভেদে চাপাতিতে শাণ দিতে ২০০ টাকা, ছোট আকারের চাকুর জন্য ৫০ টাকা, জবাইয়ের বড় ছুরি ২০০ টাকা, দা ও বটির জন্য ১০০ থেকে ১৫০ টাকা খরচ করতে হচ্ছে ক্রেতাদের।
শুক্রবার সন্ধ্যায় পাটের বস্তায় মুড়িয়ে কুবা, দা, চাকু ও ছুরিতে শাণ দিতে এসেছিলেন উপজেলার পাথালিয়া ইউনিয়নের পানধোয়া এলাকার মো. আব্দুস সাত্তার। সঙ্গে কিনেছেন একটি চাকু। সব মিলিয়ে তার ৭০০ টাকা লেগেছে। ক্রেতা হিসেবে তার দাবি, অন্য বছরের তুলনায় সব কাজে এ বছর দাম বেশি। অবশ্য এ নিয়ে কর্মকারের দাবি– লোহা, কয়লার দাম ও কর্মকারের মজুরি আগের তুলনায় এখন অনেক বেড়ে গেছে। কয়লার দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন আর আগের মতো লাভ হচ্ছে না। সেই অনুযায়ী দাম খুব সামান্যই বাড়ানো হয়েছে।
উপজেলার পানধোয়া এলাকার হরিপদ কর্মকারের সাথে গতকাল কথা হয়। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘একদিন পরই কোরবানির ঈদ, অনেকেই নতুন দাও-ছুরি কিনবে। তাই অহন দাওয়ে (দা) আছারি (হাতল) লাগাইবো। সারা বছরই আমাগো কাম (কাজ) থাকে। কিন্তু কোরবানির সময় আইলে কামের মাত্রা বাইড়া যায় তিনগুণ। হেই সাথে আমাগো ইনকামও একটু বাড়ে।’
ঈদ উপলক্ষ্যে এই সময়ে দৈনিক ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয় বলে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন সরঞ্জামাদিতে শাণ দেয়ায় ব্যস্ত শিবু কর্মকার। তিনি জানান, এখন শুধু কর্মকাররাই কাজ করেন না। মুসলিম পরিবারের লোকজনও এই কাজ করেন।