১৩ জুন ২০২৪, ১৭:০৬

‘রাজনৈতিক দলগুলোতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার বিধান বাস্তবায়ন করতে হবে’

  © সংগৃহীত

সংরক্ষিত আসনগুলোতে নারীদের সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার বাধ্যবাধকতা কার্যকর করা, দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা প্রদান এবং সম্পত্তিতে অধিকার ও আর্থিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সোমবার (১৩ জুন) ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে দি এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ওয়েভ ফাউন্ডেশনের আয়োজনে ‘রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ: বিদ্যমান আইনি কাঠামো ও বাস্তবতা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব বলেন। 

ওয়েভ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী'র সভাপতিত্বে এতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সেলিমা রহমান, শেরীফা কাদের, রাজেকুজ্জামান রতন, নাজমা আক্তার, অধ্যাপক ড. আইনুন নাহার। মতবিনিময় সভায় দেশের বিদ্যমান আইনি কাঠামো ও ১২ জেলা থেকে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে পরিচালিত গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন গবেষক ও বিশিষ্ট জেন্ডার কনসালট্যান্ট সানাইয়া ফাহিম আনসারি। সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন এবং সঞ্চালনা করেন কানিজ ফাতেমা, প্রকল্প সমন্বয়ক ও উপ-পরিচালক, ওয়েভ ফাউন্ডেশন। এছাড়াও স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নারী শাখার নেতৃবৃন্দ, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিবৃন্দ এতে অংশগ্রহণ করেন।

সভাপতির বক্তব্যে মহসিন আলী বলেন, স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদে প্রথমবার যখন নারীরা সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন তখন যে উৎসাহ ছিল, পরবর্তীকালে সে উৎসাহে ভাটা পড়েছে। কারণ নির্বাচিত নারীদের যথাযথ সম্মান ও কাজের সুযোগ দেয়া হয়নি। সেজন্য প্রতি নির্বাচনে ৩টি করে আসনে সরাসরি ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নারী প্রতিনিধি নির্বাচন করা প্রয়োজন। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কারণে নারীরা নেতৃত্বে এলেও সবসময় নারীর অধিকার ও উন্নয়নে তারা ভূমিকা রাখতে পারেন না। পর্যালোচনার আলোকে তাই নীতিগত কিছু বিষয়ে পরিবর্তন আনা দরকার।

গবেষণার ফলাফল উপস্থাপনকালে সানাইয়া ফাহিম আনসারি বলেন, বাংলাদেশে নানা প্রতিবন্ধকতার পরেও নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেলেও সার্বিক অসমতা ও বৈষম্যের কারণে এক্ষেত্রে নারীকে এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। গবেষণাকালে ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, বরিশাল ও পটুয়াখালীর বিভিন্ন দলের নারী সদস্যদের সাথে ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশনের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে। মোট ২৭২ জন এ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছেন। বর্তমানে বিশ্বের ২৮টি দেশে নারীরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন। প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা, শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় আর্থিক সংকট প্রভৃতি এখনও এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে কিছু বৈষম্যমূলক আইন এবং আইনের দুর্বল প্রয়োগের পাশাপাশি পারিবারিক বাধা, বিয়ের পরে সময় দিতে না পারা, বাল্যবিবাহ, সম্পত্তিতে সমানাধিকার না থাকা, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, সহিংসতা ও যৌন হয়রানি, মাতৃত্বজনীত কারণে কর্মবিরতি প্রভৃতিও বাধা হিসেবে কাজ করে। সরকারের বিভিন্ন স্তরে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণ নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখলেও সংরক্ষিত আসনের নারীদের প্রতি কর্মক্ষেত্র ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিগত সমস্যা রয়েছে। নারীর দক্ষতার উপর আস্থার বিষয়েও ঘাটতি রয়েছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও নারীরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন।

গবেষণাকালে উত্তরদাতাদের কাছ থেকে যে সুপারিশগুলো পাওয়া গেছে সেগুলো হলো: সংসদের ৫০টি সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা, শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে উদ্যোগ গ্রহণ করা, নারীদের সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা, সমতার আলোকে বিদ্যমান
পারিবারিক আইনে পরিবর্তন আনা, নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা বৃদ্ধি, রাজনীতিতে সহিংসতা, অর্থ ও পেশীশক্তির প্রভাব, স্বজনপ্রীতি দূর করা, সর্বোপরি ঘরে-বাইরে সর্বত্র নারীকে সমতার দৃষ্টিভঙ্গিতে গ্রহণের সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটাতে প্রচারাভিযান চালানো।

সেলিমা রহমান বলেন, রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় পর্যায়ে নারী নেতৃত্ব দৃষ্টিগোচর হলেও তৃণমূল পর্যায়ে নারীকে সেভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। রাজনৈতিক দলে সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে নারী এখনও পিছিয়ে রয়েছে। রাজনৈতিক পরিবারের নারীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য মনোনীত করা হলেও কর্মী হিসেবে যিনি অবদান রাখেন তাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া হয় না। কেউ নেতৃত্বে এগিয়ে গেলে তার ব্যক্তিচরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। সেজন্য নারীকে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। 

নাজমা আক্তার বলেন, নারীদেরকে সচেতনভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের যথাযথ বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। 

শেরীফা কাদের বলেন, সমাজে নারীকে পিছিয়ে রাখা হলেও তাদের নিজেদেরকেও রাজনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য এগিয়ে আসতে হবে স্বেচ্ছায়। বিভিন্ন কর্মশালা ও শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে হবে। নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। নেতৃত্বে আসতে হলে নিজের একটা সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করতে হবে। সমাজে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার আরো পরিবর্তন দরকার। 

রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, পুরনো অনেক চিন্তা আমরা বাদ দিতে পারলেও নারীর সমানাধিকার বিষয়ে আমরা পুরনো ধারণাকে ত্যাগ করতে পারছি না। তার মানে কেউ বা কোনো গোষ্ঠী এ কারণে সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। নেতৃত্ব মানে একধরনের দায়িত্ব ও দক্ষতা। কিন্তু নেতৃত্ব যখন কর্তৃত্বে পরিণত হয় তখন অর্থ ও পেশিশক্তি প্রভাব বিস্তার করে। এখানেই পিছিয়ে পড়েন নারীরা। এছাড়া ধর্মীয়, আইনি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হন নারীরা। সমাজের সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্যই নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ জরুরি। 

অধ্যাপক ড. আইনুন নাহার বলেন, গবেষণার ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম বা আদিবাসী নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণের বিষয়টিকেও বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। কোভিডকালে নারী নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রগুলো দক্ষতার সাথে মহামারী নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে, যা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নারীকে পুরুষালী হওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়, কিন্তু যখন নারী ‘পুরুষালী নেতৃত্ব’ অর্জন করে তখন সেটাকে সমালোচনা করা হয়। 'সংরক্ষণ' শব্দটিকে আমরা কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখছি সেটা গুরুত্বপূর্ণ। সংরক্ষিত আসনে দলগুলো যখন নারীকে মনোনীত করে সেটা কি সবসময় ‘নেতৃত্ব’ তৈরি বা বৃদ্ধির জন্য করে থাকে? বিশ্বের সবখানেই গণতন্ত্র এখন প্রশ্নের সম্মুখীন, সে কারণেও নারীর নেতৃত্ব বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছি। বাংলাদেশে 'অংশগ্রহণ' অর্থে নয়, শুধু সংখ্যা হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোতে ৩৩ শতাংশ নারীকে নিয়ে আসতেই আমরা বারবার সময় বৃদ্ধি করে ২০৩০ সাল পর্যন্ত নিয়ে গেছি। ফলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন করার সুযোগ রয়েছে।

উল্লেখ্য, আঞ্চলিক সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের মাধ্যমে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ উৎসাহিতকরণে শিখন ও পারস্পরিক জ্ঞান বিনিময়ের চর্চার ক্ষেত্র তৈরির লক্ষ্যে দি এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ‘বিল্ডিং এ রিজিওনাল নেটওয়ার্ক অন জেন্ডার ইনক্লুশান ইন পলিটিক্যাল পার্টিসিপেশন’ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়ন ও অংশগ্রহণে সক্ষমতা, নারী রাজনীতিবিদদের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা এবং বাধা উত্তরণের পন্থা অন্বেষণ প্রভৃতি ইস্যুতে এ প্রকল্পের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।