শিক্ষকদের কথায় গুরুত্ব নেই, গোপনে মেয়েদের বাল্যবিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকরা
উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামে রয়েছে ৪২১টি চর-দ্বীপচর। এসব চরাঞ্চলের অধিকাংশ মেয়ের দারিদ্র্য, নানাভাবে উত্ত্যক্ত করা ও নিরাপত্তার অভাবে প্রতিনিয়ত ঘটছে বাল্যবিয়ের ঘটনা। এর কারণে বেশির ভাগ মেয়েই মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হতে পারছেন না। ফলে অনেক মেধাবী ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে অকালে লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়ছেন।
এই অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় বাল্যবিয়ের ভয়ানক চিত্র দেখা গেছে। জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি থেকে রুবিনা আক্তার নামের এক ছাত্রী একাই মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। এই স্কুলে পড়ুয়া রুবিনার সাত বান্ধবীর সবারই বিয়ে হয়ে গেছে।
স্কুলটির প্রধান শিক্ষক নুরুজ্জামান মিয়া বলেন, তাদের বিদ্যালয় সীমান্তবর্তী এলাকায় হওয়ায় মানুষ এখনও চলেন আগের রেওয়াজে। স্কুল থেকে প্রতি দুই সপ্তাহ পরপর মেয়েদের বাড়িতে গিয়ে পড়াশোনার গুরুত্ব নিয়ে তাদের বাবা-মায়েদের সঙ্গে তারা কথা বললেও তাদের কথা গুরুত্ব দেন না অভিভাবকরা। বয়স কম হওয়ায় গোপনে বিয়ে দিয়ে দেন তাদের মেয়েদের।
দেশে শিক্ষার হার বাড়লেও এসব গ্রাম ও চর অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায় বাল্যবিবাহের ঘটনা। পরিবারে অস্বচ্ছলতা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় চরাঞ্চলের পরিবারগুলোতে দারিদ্রতার কারণে স্কুল জীবন শেষ করার আগেই অনেক মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন অভিভাবকরা। এছাড়া রয়েছে নিরাপত্তার অভাবও।
তবে নিরাপত্তা ও দারিদ্রতার পাশাপাশি এ ঘটনার অন্যতম আরেকটি কারণ হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক কুমারী নারীদের সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা। এ কারণেও অল্প বয়সেই এ অঞ্চলের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন বলে অভিভাবকরা জানিয়েছেন।
জানা যায়, ফুলবাড়ি উপজেলার ওই স্কুলটিতে গত এক বছরে সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির ১৬ জনের বিয়ে হয়েছে। তারা প্রত্যেকেই গ্রামের সাধারণ কৃষক পরিবারের। এছাড়া চিলমারী উপজেলার রমনা ইউনিয়নের কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এক বছরে ২২ ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে।
এর মধ্যে রিয়াজুল জান্নাহ দাখিল মাদ্রাসার সুপার মাওলানা আব্দুল আজিজ বলেন, তাদের ইউনিয়ন একেবারে দরিদ্র এলাকা হওয়ায় অভিভাবকরা আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়ে লুকিয়ে বিয়ে দেন। ছয় মাসে তাঁর মাদ্রাসার ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির আট ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। তারা আর মাদ্রাসায় আসে না।
আরও পড়ুন: শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা সংখ্যা কমলেও উদ্বেগ কমেনি
একই চিত্র দেখা গেছে উলিপুর উপজেলার হযরত ফাতিমা (রা.) পৌর বালিকা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সাতদরগা টাইটেল মাদ্রাসা, কৃষ্ণমঙ্গল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, কলাকাটা দাখিল মাদ্রাসাসহ প্রান্তিক পর্যায়ের বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে চলতি বছর ৪৫ শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের কারণে লেখাপড়া বাদ দিয়েছেন।
উপজেলার কলাকাটা দাখিল মাদ্রাসার সুপার মশিউর রহমান বলেন, এ বছরে তাঁর প্রতিষ্ঠানের ২১ শিক্ষার্থী দশম শ্রেণিতে ওঠার পর বিয়ে হয়ে যাওয়ার কারণে আর মাদ্রাসায় আসে না।
বিয়ের কারণে পড়াশোনা থেকে বাদ পড়া এসব নারীরা বলছেন, তাদের পড়াশোনা করে ভালো চাকরি করার ইচ্ছা থাকলেও পরিবারে অভাব আর সমাজের মানুষ ও মুরব্বিদের নানা কথায় তাদের বিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এসব ঘটনায় পরিবারগুলোর অভিভাবকদের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদেরও দায়ী করছেন সচেতন নাগরিকরা। এই সমস্যার অন্যতম কারণ হিসেবে সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, দারিদ্র্য, কুসংস্কার, যৌতুক ও প্রান্তিক অঞ্চল হওয়ায় শিক্ষার অধিক ব্যয়কেও দায়ী করছেন তারা।
বাল্যবিয়ে বন্ধে সচেতনতামূলক কাজ করলেও বাস্তবতা ভিন্ন বলে গণমাধ্যমকে জানান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ। তবে তিনি সামাজিক এই সমস্যা নিরসনে পদক্ষেপ নিবে বলে জানান।