সাকরাইন উৎসবে সেজেছে পুরান ঢাকা
ছয় ঋতুর দেশে এখন চলছে শীতকাল যা বাংলা মাসের হিসেবে পৌষের বিদায়ক্ষণ। বারো মাসে তেরো পার্বনের দেশে এই পৌষ মাসের শেষ দিনটিকে ঘিরে রয়েছে একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব। পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের কাছে যা সাকরাইন উৎসব হিসেবে পরিচিত থাকলেও কেউ কেউ এটিকে পৌষ সংক্রান্তিই বলে থাকে।
পৌষ মাসের শেষ দিনে পুরাণ ঢাকায় পালিত হয় সাকরাইন উৎসব। তবে শাঁখারিবাজারের আদি হিন্দু পরিবারগুলি একদিন পরে এ উৎসব পালন করে। বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে ছোটবড় সকলেই মেতে উঠে এ উৎসবে। দিনের শুরু থেকেই পুরান ঢাকার বাড়িতে বাড়িতে চলে পিঠা বানানোর ধুম। সারাদিন এই সব এলাকায় আকাশে রঙ বেরঙের ঘুড়ি ওড়ে। ছাদে কিংবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘুড়ি ওড়ানো হয়। অধিকাংশ সময়ে ঘুড়ি কাটার প্রতিযোগিতা চলে। একজন অপরজনের ঘুড়ির সুতা কাটার প্রতিযোগিতা করে।
শনিবার (১৩ জানুয়ারি) সরেজমিনে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায় সাকরাইনকে সামনে রেখে পুরান ঢাকায় উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুর, গেণ্ডারিয়া, লালবাগ ও এর আশেপাশের এলাকাগুলো সাকরাইন উৎসব পালন করতে প্রস্তুত করা হচ্ছে। বেশিরভাগ বাসার ছাদে সাউন্ড-সিস্টেম, আলোকসজ্জা ও লাইটিং করে সাজানো হচ্ছে।
শাঁখারিবাজারের ঘুড়ি ও আতশবাজির দোকানগুলোতে বেড়েছে ক্রেতাদের ভিড়। শাঁখারি বাজারের কয়েকজন দোকানির সাথে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন ধরনের আঁকার আকৃতির ঘুড়িগুলো এখানে তৈরি হয় ও এদের নামও বেশ চমৎকার যেমন চোখদার, পানদার, বলদার, দাবাদার, লেজওয়ালা, পতঙ্গ ইত্যাদি নামের ঘুড়ি।
তারা আরও জানান, সাধারণ ঘুড়িগুলোর দাম ৫ থেকে ২৫ টাকার মধ্যে, হরেক রকমের ডিজাইন করা ঘুড়িগুলোর দাম ১৫০ টাকা থেকে ৬০০ টাকার বেশি হয়। এছাড়াও দোকানগুলোতে ভারত ও চায়নার ঘুড়িও পাওয়া যায়। তারা এই সাকরাইন উৎসব চলাকালীন সময়েই ঘুড়িগুলো নিজেরাই প্রয়োজনীয় উপকরণ দিয়ে তৈরি ও আমদানি করে থাকে।
ইংরেজি নববর্ষের অনুষ্ঠানে ফানুস ও আতসবাজিতে বিভিন্নস্থানে দুর্ঘটনা ঘটায় সরাসরি ফানুস ও আতশবাজি বিক্রি হচ্ছে না শাঁখারিবাজারে—তবে গোপনে চলছে বিকিকিনি। পুরান ঢাকার শাঁখারিবাজার এলাকার কয়েকটি গলির মাথায় ও দোকানের কোণে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে থাকে বেশ কয়েকজন তরুণ ও কিশোর। যাদের বেশিরভাগেরই বয়স ১৫ থেকে ২২ বছরের মধ্যে। কেউ কিনতে এসে খোঁজাখুঁজি করলে কোনো না কোনোভাবে টের পেয়ে যায় গলি ও দোকানের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলো। তখনই চার-পাঁচজন এসে হাজির। গলির ভেতর ডেকে নিয়ে চলে দরদাম। এভাবেই প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলছে আতশবাজির বিকিকিনি।
শাঁখারি বাজারের ঘুড়ির দোকানি জনি সেন বলেন, বছরের শুরু থেকেই দোকানে সাকরাইনের জন্য সব ধরনের মালামাল উঠিয়েছেন তিনি, সবচেয়ে বেশি উঠিয়েছেন ঘুড়ি, আবির, সুতা, নাটাই। বর্তমানে বিক্রি একটু কম হলেও শেষ দিনে বেশি বিক্রির আসা তার। সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকায় এবছর বেচাকেনার সাথে লাভের হারও একটু বলে জানান তিনি।
ঘুড়ি কিনতে আসা সাখাওয়াত হোসেন নামের একজন বলেন, আমি তিন ধরনের ঘুড়ি কিনেছি, সুতা-নাটাই আগে থেকেই আছে। বাসায় গিয়ে ঘুড়ির জন্য কিছুটা কাজ করব তারপর সাকরাইনের দুই দিন দুপুরের পর থেকে আমরা বাড়ির সবাই মিলে ছাদে ঘুড়ি উড়াব, গানবাজনা করব। তবে করোনা ঝুঁকি থাকায় তার বন্ধুদের সাথে সাকরাইন পালনে সীমাবদ্ধতা থাকবে বলে জানান তিনি।
সাকরাইন নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সোহেল ইমাম বলেন, এটা পুরোনো ঢাকার আদি ঐতিহ্য। সারাদিন ঘুড়ি উড়ানো শেষে রাতের বেলা আতশবাজি ফুটানো হয়। দিনভর উৎসব মুখর পরিবেশ থাকে। নানা শ্রেণি পেশার মানুষ সমবেত হন সাকরাইনে। পুরোনো ঢাকার বাহির থেকেও লোকজন আসে সাকরাইন উৎসবে যোগ দিতে। কর্মব্যস্ত থাকার পরেও সাকরাইনে উৎসবে সবাই মেতে উঠে।
এবারের সাকরাইনে ফানুস উড়ানো ও আতশবাজি ফুটানোর কোন বিধি-নিষেধ আছে কিনা জানতে চাইলে সূত্রাপুর থানার ওসি মাসুদ আলম বলেন, এটা মূলত পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে ডিএমপি কমিশনার স্যার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। প্রতিবারের মত ফানুস উড়ানো এবারও নিষিদ্ধ তবুও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু জায়গায় উড়ানো হয় আমরা এটা প্রতিরোধের চেষ্টা করবো। সাকরাইনে যাতে কোনো ধরনের জনসমাগম না ঘটে সে দিকে আমরা লক্ষ্য রাখবো।