১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:৩৪

দেশপ্রেমে বলিয়ান সাংবাদিক সেলিনা পারভীন

শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন  © সংগৃহীত

দেশপ্রেমে বলিয়ান সাংবাদিক সেলিনা পারভীন। তিনি ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা দায়িত্বশীল মানুষ, একজন স্বাধীন সাহসী কলম সৈনিক। একজন সংগ্রামী মা। কাগজে-কলমে-সংবাদে-সত্যে আপোষহীন সাংবাদিক। যিনি ১৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শিকার হওয়ার আগ পর্যন্ত সাংবাদিকতা করে গিয়েছেন।

সেই হত্যাকান্ড চালিয়ে যেতে থাকে বিরামহীনভাবে। সেই পরিকল্পনা অনুসারে একে একে হত্যা করে এ দেশের মেধাবী, আলোকিত ও বরেণ্য মানুষকে। নানা পেশার মেধাবী ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে তারা। হত্যা পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য পাকিস্তানিরা গড়ে তোলে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের প্রস্তুতি নেয়া হতে থাকে। মূলত ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পনার মূল অংশ বাস্তবায়ন হয়। অধ্যাপক, সাংবাদিক, শিল্পী, প্রকৌশলী, লেখকসহ চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসররা জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যায়। প্রায় ২০০ জনের মতো বুদ্ধিজীবীকে বাসা থেকে ধরে বিভিন্ন নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের ওপর বীভৎস নির্যাতন চালানো হয়। পরে তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। দেশের এই সেরা সন্তানদের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ পাওয়া যায় রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে।

সেলিনা পারভীনের জন্ম বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার ফেনীর ছোট কল্যাণনগর গ্রামে, ১৯৩১ সালের ৩১ মার্চ। বাবা মৌলবি আবিদুর রহমান। মাতা মোছাম্মদ সাজেদা খাতুন। নয় ভাই-বোনের মধ্যে সেলিনা পারভীন ছিলেন তৃতীয়। সেলিনা পারভীনের পিতৃদত্ত নাম ছিল মনোয়ারা বেগম মণি। বাবা মৌলবি আবিদুর রহমান ছিলেন ফেনীর গুরু (টিচার্স) ট্রেনিং স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ছাত্রজীবনে সেলিনা পারভীনের বাবা ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। তার মা সাজেদা খাতুনও প্রায় ১২ বছর শিক্ষকতা করেছেন। তৎকালীন বাঙালি মুসলমান পরিবারের রক্ষণশীলতার যুগেও সেলিনা পারভীনের পরিবার ছিল অনেক দিক থেকেই উদার ও স্বাধীনচেতা। নিয়মিত সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় পরিবারের ছেলেমেয়েদের প্রগতির প্রতি দুর্বার আকর্ষণ গড়ে ওঠে। সুযোগ পেলেই বাড়িতে বসতো গানের আসর, ছেলেমেয়েরা মিলে মঞ্চস্থ করত পারিবারিক নাটক। পরিবারের বড়রা হতেন সেসব আসরের শ্রোতা। আর এসবের মধ্যমণি ছিলেন সেলিনা পারভীন। যে কোনো গান একবার শুনলেই হুবহু গেয়ে ফেলতে পারতেন, দারুণ শখ ছিল ছবি আঁকার। উল দিয়ে বাঁশের চালুনির উপর কারুকাজ বা রঙ দিয়ে মাটির সরার উপর কারুকাজের হাতও ছিল দেখার মতো। ছবি আঁকা, সংগীতচর্চা, বস্নক তৈরি এবং ডিজাইনের কাজে নিজেকে যুক্ত রাখতেন।

সেলিনা পারভীন ছিলেন তেমনি একজন বরেণ্য সাংবাদিক। ১৯৪৫ সাল থেকেই তিনি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকায় সম্পাদকের সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৭ সালে যোগ দেন সাপ্তাহিক ললনা পত্রিকায়। তিনি এ সময় থেকেই নিবন্ধ রচনা ও সাংবাদিকতায় দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি ললনা পত্রিকার বিজ্ঞাপন বিভাগে কাজ করতেন। বিজ্ঞাপন সংগ্রহ ও টাকা তোলাসহ সব কাজ একাই করতেন। 

দেশের বুদ্ধিজীবীদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত শিলালিপি সবার নজর কেড়েছিল। স্বাধীনতার পক্ষের পত্রিকা শিলালিপি। বাম চিন্তাধারার ধারক সেলিনা পারভীনের সবচেয়ে বড় উদ্যোগ ছিল 'শিলালিপি'র মতো একটি পত্রিকা প্রকাশ করা। তিনি হেঁটে হেঁটে লেখা ও অর্থের জোগাড় করে বহু কষ্টে এই পত্রিকা প্রকাশ করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার শিলালিপি পত্রিকার প্রচ্ছদ ও বিভিন্ন রচনা পাকসেনাদের দোসর রাজাকারদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। সেলিনা পারভীন স্বাধীনতার পক্ষে পত্রিকা বের করে পাকিস্তানবাহিনীদের টার্গেট হন এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ঘাতকদের হাতে শহীদ হন। ১৯৬৭ থেকে মৃতু্যর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন শিলালিপি পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক। ১৯৬৯ সালে তার একক প্রচেষ্টায় সম্পাদিত ও প্রকাশিত হয় শিলালিপি পত্রিকা।

১৯৬৯-এর রাজনৈতিক আন্দোলনে যখন উত্তাল বাংলাদেশ তখন তিনি সেই গণঅভু্যত্থানের আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ছেলেকে সঙ্গে নিয়েই বেরিয়ে পড়তেন পল্টনের জনসভায় বা শহীদ মিনার থেকে বের হওয়া নারীদের মিছিলে যোগ দিতে। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, শহীদুলস্না কায়সার প্রমুখ ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে সমাজতন্ত্রের প্রতিও আগ্রহী ছিলেন তিনি। শুরু হয় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের টাকা ও খাবার সরবরাহ করে সহযোগিতা করতেন তিনি। মূলত, শিলালিপির বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় সেলিনা পারভীন ঢাকায় ছিলেন। তিনি সিদ্ধেশ্বরীর (তৎকালীন ১১৫নং নিউ সার্কুলার রোড) একটি বাসায় থাকতেন। চারদিকে চলছে আক্রমণ ও প্রতিরোধ। চারপাশে শুধু বুলেটের শব্দ আর বারুদের গন্ধ। এরই মধ্যে ললনা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। শিলালিপির উপরও নেমে আসে দুর্ভোগ। হাশেম খানের প্রচ্ছদ করা একটি শিলালিপির প্রকাশিতব্য সংখ্যা নিষিদ্ধ করে দেয় পাকিস্তান সরকার। পরে প্রকাশের অনুমতি মিললেও নতুনভাবে সাজানোর শর্ত দেয়া হয়। সেলিনা পারভীন বরাবরের মতো প্রচ্ছদ না নিয়ে তার ভাইয়ের ছেলের ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ করে আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে শিলালিপির সর্বশেষ সংখ্যা বের করেন। কিন্তু এর আগের সংখ্যার জন্যই সেলিনা পারভীন পাকিস্তানি ও তাদের দালালদের নজরে পড়ে যান, যেটাতে ছিল দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের স্বাধীনতার পক্ষে লেখা। শিলালিপির আরেকটি সংখ্যা বের করার আগে তিনি নিজেই হারিয়ে গেলেন।

১৩ ডিসেম্বর তার সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে আলবদর কর্মীরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। তিনি ছিলেন একটু শীত-কাতুরে। সবসময় পায়ে মোজা আর মাথায় স্কার্ফ ব্যবহার করতেন। ১৪ ডিসেম্বর আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর মতো পাকিস্তানের দালাল আলবদর বাহিনীর নরপশুরা সেলিনা পারভীনকে হত্যা করে। ১৮ ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তার ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায়। পায়ের মোজা দেখে আত্মীয়রা তাকে চিহ্নিত করতে পারে। সেলিনা পারভীন ছিলেন অকুতোভয় একজন নারী।