২০ বছর পর পদ ফিরে পেলেন প্রধান শিক্ষক
পঞ্চগড় জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম নয়নীবুরুজ দীঘলগ্রাম। সেখানে শিশু শিক্ষায় ছিল না কোনো বিদ্যালয়। ১৯৯২ সালে নয়নীবুরুজ দীঘলগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিজ হাতে গড়ে তোলেন আকবর হোসেন নামে এক ব্যক্তি। এর মধ্যে নিজের গড়া বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন তিনি।
বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পর রেজিস্ট্রেশন হয় এবং আকবরসহ শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত হন। বিদ্যালয়ের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছিল। এর মধ্যে পারিবারিক কোন্দল ও ষড়যন্ত্রের শিকার হন আকবর। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদমর্যাদা থেকে বঞ্চিত থাকার দীর্ঘ ২০ বছর পর অবশেষে আদালতের নির্দেশে নিজের পদ ফিরে পেয়েছেন আকবর হোসেন।
বৃহস্পতিবার (০২ নভেম্বর) সব কার্যক্রম শেষে দুপুরে নিজ হাতে গড়ে তোলা নয়নীবুরুজ দীঘলগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন তিনি। এ সময় বিদ্যালয়ে সাবেক সহকর্মী ও স্থানীয় বাসিন্দারা তাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। পরে মিষ্টি বিতরণ করা হয়।
মামলার বিবরণ ও আকবর হোসেনের পরিবার জানায়, দীঘলগ্রামে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় ১৯৯২ সালে নয়নীবুরুজ দীঘলগ্রাম বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন আকবর আলী। ২০১৩ সালে বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ করা হয়। তার অনেক আগেই সভাপতি হবিবর রহমানের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় আকবর হোসেন শিকার হন ষড়যন্ত্রের। ২০০১ সালে স্ত্রীর সঙ্গে বিরোধের একটি মামলায় তিন মাস কারাগারে ছিলেন। পরে সমঝোতা হওয়ায় জামিনে মুক্তি পান আকবর হোসেন।
কারাগার থেকে বের হওয়ার পর সভাপতি হবিবর রহমান তাকে বিদ্যালয়ে ঢুকতে দেননি। আকবর হোসেন কারাগারে থাকাকালীন তাকে কৌশলে বাদ দিয়ে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিসহ প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সংশ্লিষ্টরা সভাপতির ভাতিজা বউ আয়েশা সিদ্দিকাকে নিয়োগ দেন।
এ ঘটনায় ২০০৪ সালে আদালতে মামলা করেন আকবর হোসেন। মামলায় আকবরকে সপদে বহাল ও তার বকেয়া বেতন পরিশোধের নির্দেশ দেন আদালত। এরপর এ মামলা গড়িয়েছে উচ্চ আদালত পর্যন্ত। হয়েছে রায়, আপিল আর পাল্টা আপিল। সবশেষ ২০২২ সালের ১৮ মে উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ শুনানি শেষে নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখেন এবং আয়েশা সিদ্দিকার নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করেন। অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া আয়েশা সিদ্দিকাকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়। কিন্তু আকবরকে যোগদান করাতে টালবাহানা শুরু করে প্রাথমিক শিক্ষা অফিস।
আদালতের নির্দেশ অমান্য করে তারা তাকে সপদে বহাল না রেখে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন। উপায় না পেয়ে ২০২২ সালের শেষ দিকে পঞ্চগড় সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে মামলা করেন আকবর হোসেন। আকবর আলীকে যোগদান করানোর আদালতের নির্দেশ অমান্য করায় আদালত ২৯ অক্টোবর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাসহ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এরপরই গ্রেফতার এড়াতে তড়িঘড়ি করে বৃহস্পতিবার পঞ্চগড় সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে আকবর হোসেনকে যোগদান করিয়ে বিদ্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়।
বিদ্যালয়ের শিক্ষক আজম আলী প্রধান বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে শিক্ষকতা শুরু করি। এ বিদ্যালয়ের জন্য তিনি (আকবর হোসেন) অনেক কষ্ট করেছেন। তারপর দীর্ঘ ২০ বছর আদালতের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরেছেন। আজ তিনি আবার যোগদান করায় আমরা খুবই আনন্দিত।’
আকবর হোসেনের আইনজীবী আসাদুজ্জামান বলেন, আমি আকবর হোসেনের জারি মামলার আইনজীবী ছিলাম। সংশ্লিষ্টরা উচ্চ আদালতের নির্দেশনা না মানায় এ মামলা করা হয়। বিবাদীদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হলেও তারা কোনো জবাব না দেওয়ায় আদালত তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ারা জারি করেন। এরপর প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা কাগজপত্র যাচাই করে তাকে বিদ্যালয়ে যোগদান করিয়েছেন।
এ বিষয়ে আকবর হোসেন বলেন, ‘এ মামলার পেছনে আমার সবকিছু শেষ করে ফেলেছি। ছেলে দুইটাকেও ভালো করে লেখাপড়া করাতে পারিনি। ২০ বছর ধরে আমি সংগ্রাম করছি। চরম অভাবে দিন পার করেছি। তবুও ন্যায়বিচারের আশায় বছরের পর বছর ঘুরেছি।’
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আমিনুল ইসলাম মণ্ডল বলেন, আমার নিজের যোগদানের মাত্র দুই মাস হয়েছে। এ মামলার কিছুই জানতাম না। তবে চাকরি সংক্রান্ত দীর্ঘদিন একটি মামলা চলার পর আদালতের নির্দেশে আমরা আকবর হোসেনকে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের অনুমতি দিয়েছি। তিনি আজ বিদ্যালয়ে যোগদান করেছেন।