২৯ আগস্ট ২০২৩, ১৪:২২

বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ, কমেছে গড় আয়ু

বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ  © সংগৃহীত

বায়ুদূষণের বিবেচনায় বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ বাংলাদেশ। এই দূষিত বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার কারণে বাংলাদেশিদের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে প্রায় ৬ দশমিক ৮ বছর। এলাকাভেদে এই পরিস্থিতি আরও করুণ। এক গবেষণায় এর কারণ হিসেবে যানবাহনের কালো ধোঁয়া, ইট ভাটা থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া, আবর্জনা পোড়ানো ইত্যাদি নানা বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। গ্রামে-গঞ্জে রান্নার কাজে ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া ইত্যাদি নানা কারণেই বাংলাদেশের বাতাস অনেক দিন ধরেই দূষিত।

মঙ্গলবার (২৯ আগস্ট) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। বাংলাদেশের মধ্যে একেক এলাকার বায়ুর অবস্থা একেক রকম। এর মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর হচ্ছে গাজীপুর। ঢাকার সবচেয়ে কাছের ওই শিল্প এলাকার মানুষদের আয়ু বায়ুদূষণের কারণে ৮ বছর ৩ মাস কমে যাচ্ছে।

এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স, ২০২৩ এই শিরোনামে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট বৈশ্বিক এই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনের জন্য মূলত স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ২০২১ সালের বাতাসের গুণমান বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে দেখা যাচ্ছে, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে সর্বোচ্চ যে দূষণ কণা মান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্তৃক অনুমোদিত, অর্থাৎ ৫ মাইক্রোগ্রাম, বাংলাদেশের বাতাসে দূষণকারী এসব গ্যাসীয় কণার উপস্থিতি তার চাইতে ১৪ থেকে ১৬ গুণ বেশি।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ১৫ মাইক্রোগ্রামকে মানদণ্ড হিসেবে নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের বাতাসে দূষণকারী এসব গ্যাসীয় কণার উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটারে ৭০ থেকে ৮০ মাইক্রোগ্রাম, যা দেশ হিসেবে বিশ্বে সর্বোচ্চ, যদিও ভারতের উত্তর সমতল, বিশেষত রাজধানী দিল্লির আশেপাশে এরকম কণার উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটারে ১২৬ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত পাওয়া গেছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত মানের চেয়ে প্রায় ২৫ গুণ বেশি।

“যদিও কিছু ভারতীয় বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাসে শ্বাস নেয়, সামগ্রিকভাবে সবচেয়ে দূষিত দেশ বাংলাদেশ,” শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদনটিতে এমনটিই উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের সবচেয়ে কম দূষিত যে জেলা সেই সিলেটেও কণা দূষণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানের চেয়ে ৯.৭ গুণ এবং জাতীয় মানের ৩.২ গুণ বেশি বলে জানিয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনটি। 

গড় আয়ু বিবেচনা, বায়ুদূষণ বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হৃদরোগের পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম হুমকি বলে প্রতিবেদনটি উল্লেখ করেছে। এর প্রভাব ধুমপানের চেয়ে মারাত্মক। তামাক সেবনের কারণে গড় আয়ু যেখানে কমে যাচ্ছে ২.১ বছর, যখন শিশু এবং মাতৃ অপুষ্টি গড় আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে ১.৮ বছর, বায়ু দূষণের প্রভাব দেখা যাচ্ছে এর চাইতে কয়েক গুণ বেশি।

বায়ুদূষণের ফলে মানুষের গড় আয়ুতে সবচাইতে বেশি প্রভাব পড়ছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এই দুটি অঞ্চলে প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষের বসবাস। দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেওয়ার কারণে বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৪৫ শতাংশেরও বেশি এই অংশটি গড় আয়ু হারাচ্ছে ৭.৬ বছর। 

বাংলাদেশ যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী বায়ুদূষণ কমিয়ে আনতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনবহুল জেলা ঢাকার বাসিন্দাদের আয়ু বেড়ে যাবে ৮.১ বছর। দেশের দ্বিতীয় সর্বাধিক জনবহুল চট্টগ্রাম জেলার বাসিন্দারা বাড়তি ৬.৯ বছর আয়ু লাভ করবে বলে জানিয়েছেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা।

বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সবচাইতে দূষিত দেশ বললেও গবেষকরা জানিয়েছেন ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে বাংলাদেশে বায়ু দূষণ ২.২ শতাংশ কমেছে যদিও এর কোনও কারণ তারা উল্লেখ করেননি। তবে বাংলাদেশের স্থানীয় বিশেজ্ঞরা বলেছেন, কোভিডকালীন লকডাউনের কারণেই মূলত সেসময় সাময়িক কিছু অগ্রগতি হয়েছে। তবে ২০২২ সালে কোভিড পরবর্তী সময়ে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হতে শুরু করলে আবার বায়ুদূষণ বেড়েছে বলেই তারা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশে আয়ু কমার আশঙ্কা থাকলেও পাকিস্তানিদের আয়ু বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি নেপালিদের আয়ুও বাড়তে পারে বলে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। 

দূষণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে চীনকে উদাহরণ হিসেবে মানছেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। ২০১৩ সালে ‘দূষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করে চীন। এর ফলে গত এক দশকে চীনের দূষণ কমেছে ৪২.৩ শতাংশ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এরকমই একটা যুদ্ধ প্রয়োজনীয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ বাতাস মানমাত্রার চেয়ে খারাপ বা দূষিত।

আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে কঙ্গো, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি এবং দক্ষিণ আমেরিকার গুয়াতেমালা, বলিভিয়া ও পেরুর বায়ুর মান সবচেয়ে খারাপ। তবে যুক্তরাষ্ট্র নানা উদ্যোগের মাধ্যমে বায়ুর মানের উন্নতি করেছে। দেশটি ১৯৭০ সালের তুলনায় বায়ুর মান ৬৫ শতাংশ উন্নতি করেছে। তবে বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা এক বছর চার মাস বেশি বাঁচে। এর কারণ দেশটি নির্মল বায়ু আইন করেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ওই আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে তুলেছে।

বায়ুর মানের দিক থেকে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে ইউরোপের দেশগুলো। এখানকার অধিবাসীরা ১৯৯৮ সালের তুলনায় ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ ভালো বায়ুর মধ্যে বসবাস করছে। এখানকার বেশির ভাগ দেশ এয়ার কোয়ালিটি ফ্রেমওয়ার্ক ডিরেক্টিভ তৈরি করেছে। ওই আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এখনো সেখানকার ৯৮ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ ডব্লিউএইচওর মানমাত্রার চেয়ে খারাপ বায়ুর মধ্যে বাস করে। তবে তারা ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ুর মান ওই মানমাত্রায় পৌঁছানোর পরিকল্পনা নিয়েছে।

সূত্র: রয়টার্স