২১ জুন ২০২৩, ০৯:৫০

জিলহজ মাসের ১০ আমল, যে দিনগুলোতে রোজা রাখা সুন্নত

জিলহজ মাস অনেক ফজিলতপূর্ণ একটি মাস  © সংগৃহীত

কিছু মাস নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ১২ মাসে বছর হয়। আরবি হিসাবে সর্বশেষ মাস জিলহজ। হজের মাস মানে জিলহজ মাস। এটি অনেক ফজিলতপূর্ণ একটি মাস। হজের আনুষ্ঠানিকতা মূলত তিন মাস ধরে। সেগুলো হলো শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ। এর মধ্যে প্রধান হলো জিলহজ মাস। এই মাসের প্রথম ৯ দিন রোজা রাখা সুন্নত। এসব দিনে রোজার বিশেষ ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। হাফসা (রা.) বর্ণনা করেছেন, চারটি আমল নবী করিম (সা.) কখনো ছাড়তেন না। 

জিলহজের প্রথম ১০ দিনের আমলের ফজিলত সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে জিলহজের প্রথম দশকের নেক আমলের চেয়ে অন্য কোনো দিনের আমলই উত্তম নয়।’ আশুরার রোজা, জিলহজের প্রথম দশকের রোজা, প্রতি মাসের তিন দিনের রোজা, ফজরের আগে দুই রাকাত সুন্নত নামাজ। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ২৪১৫) 

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমার একেকটি রোজার বিনিময়ে ১০০ দাস আজাদ করার, ১০০ উট দান করার এবং জিহাদের সাজে সজ্জিত একটি ঘোড়া জিহাদের জন্য দান করার সওয়াব হবে। আরাফাতের দিন তথা জিলহজের রোজার বিনিময়ে ২ হাজার দাস মুক্ত করার, ২ হাজার উট দান করার, জিহাদে সজ্জিত ২ হাজার ঘোড়া দান করার পুণ্যপ্রাপ্ত হবে।’ (মুকাশাফাতুল কুলুব, ইমাম গাজ্জালি)

বর্ণিত হয়েছে, এক যুবকের অভ্যাস ছিল, সে জিলহজ মাসের চাঁদ দেখা দিলেই রোজা রাখত। মহানবী (সা.) তা জানতে পেরে যুবককে জিজ্ঞেস করেন, ‘হে যুবক, তুমি কেন এই দিনগুলোতে রোজা রাখো?’ জবাবে সে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আমার মা-বাবা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক। এই দিনগুলো পবিত্র হজের প্রতীক ও হজ আদায়ের বরকতময় সময়। হজ আদায়কারীর সঙ্গে আমিও নেক আমলের আশায় অংশীদার হই, তার সঙ্গে আমার দোয়া আল্লাহ তাআলা কবুল করে নেবেন।’

আর ৯ জিলহজ তথা আরাফার দিন রোজা রাখলে আগে ও পরে এক বছর গুনাহ মাফ হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আরাফার দিন (৯ জিলহজ) রোজার বিষয়ে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে তিনি এর মাধ্যমে বিগত এক বছর ও আগামী বছরের গুনাহ মাফ করবেন। (মুসলিম, হাদিস : ১১৬২)

নফল ইবাদত
রাসুল (স.) বলেন, ‘আল্লাহর কাছে জিলহজের প্রথম দশকের নেক আমলের চেয়ে বেশি প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। এ দিনগুলোর এক দিনের রোজা এক বছরের রোজার সমতুল্য এবং এক রাতের ইবাদত শবে কদরের ইবাদততুল্য।’ (তিরমিজি, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা-১৫৮) জিলহজের গুরুত্ব ও ফজিলত

কোরবানি পর্যন্ত নখ-চুল না কাটা
জিলহজ মাস শুরু হওয়ার আগে নখ, চুল, গোঁফ, বোগল-নাভির পশম ইত্যাদি কেটে নেওয়া উচিত। কেননা জিলহজ শুরু হলে এসব কাটা থেকে বিরত থাকা সুন্নত ও মোস্তাহাব আমল।  বিশেষ করে যারা কোরবানি করার সংকল্প করেছেন, তাদের উদ্দেশ্য করে নবীজি (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির কাছে কোরবানির পশু আছে সে যেন জিলহজের নতুন চাঁদ দেখার পর থেকে কোরবানি করা পর্যন্ত তার চুল ও নখ না কাটে।’ (মুসলিম: ৪৯৫৯, আবু দাউদ: ২৭৮২) 

জিকিরের গুরুত্ব 
এই দিনগুলোতে তাকবির (আল্লাহু আকবর), তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ), তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও তাসবিহ (সুবহানাল্লাহ) পড়া সুন্নত। এসব দিনে জিকিরের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে এই ১০ দিনের আমলের চেয়ে বেশি প্রিয় ও মহান কোনো আমল নেই। তাই তোমরা এই সময় তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবির (আল্লাহু আকবর) ও তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ) বেশি বেশি করে পাঠ করো।’ (বায়হাকি, শুআবুল ঈমান: ৩৪৭৪) জিলহজ মাসের আমল

জিলহজ মাসে রোজা
জিলহজ মাসে রোজার গুরুত্বও অনেক বেশি। বিশেষ করে প্রথম ৯ দিনের মধ্যে নবম দিনের রোজা সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘আরাফার দিনের (৯ তারিখের) রোজার বিষয়ে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে তিনি এর দ্বারা বিগত এক বছর ও আগামী বছরের গুনাহ মাফ করবেন। (সহিহ মুসলিম: ১১৬২; আবু দাউদ: ২৪২৫) জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন যেসব আমল করবেন

বিশেষ আমল কোরবানি
মনে রাখা দরকার, জিলহজ মাসের বিশেষ আমল হলো কোরবানি করা। এটি সামর্থ্যবানদের ওপর ওয়াজিব। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি তোমার রবের জন্য নামাজ আদায় করো এবং কোরবানি করো’ (সুরা কাউসার: ২)। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে। (সহিহ বুখারি: ৬৪৯০; ইবনে মাজাহ: ৩১২৩) জিলহজ মাসের ১০ আমল

হজের মাসের পবিত্রতা রক্ষায় গুনাহ বর্জন
জিলহজ মাস হচ্ছে হজের মাস। হজের সময়ের পবিত্রতা রক্ষায় মহান আল্লাহ বলেন, ‘হজ নির্ধারিত মাসগুলোতে (অনুষ্ঠিত হবে)। অতঃপর কেউ এ মাসগুলোতে হজের ইচ্ছা করলে সে যেন হজের সময় স্ত্রী-সম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও কলহ-বিবাদ করবে না।’ (সুরা বাকারা: ১৯৭)

মর্যাদাপূর্ণ আমল হজ-ওমরা
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তোমরা পরপর হজ ও ওমরা করো। কেননা, হজ ও ওমরা দারিদ্র ও গুনাহ মিটিয়ে দেয়, যেমন হাপরের আগুনে লোহা ও সোনা-রূপার ময়লা দূর হয়। কবুল হজের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়। (তিরমিজি: ৭৫৭)

তাকবিরে তাশরিক
জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজরের নামাজ থেকে ১৩ তারিখ আসরে নামাজ পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের শেষে একবার করে বিশেষ তাকবির বলা ওয়াজিব। যাকে তাকবিরে তাশরিক বলা হয়। এই তাকবিরটি হলো— ﺍﻟﻠﻪ ﺃﻛﺒﺮ ﺍﻟﻠﻪ ﺍﻛﺒﺮ، ﻻ ﺇﻟﻪ ﺇﻻ ﺍﻟﻠﻪ، ﻭﺍﻟﻠﻪ ﺃﻛﺒﺮ ﺍﻟﻠﻪ ﺃﻛﺒﺮ ﻭﻟﻠﻪ ﺍﻟﺤﻤﺪ উচ্চারণ: ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওআল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ’ অর্থ: আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান। আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো উপাস্য নেই। আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। (দারু কুতনি: ১৭৫৬; ইরওয়াউল গালিল: ৬৫৪) 

তাওবা
বান্দা যখন নিজের অপরাধ বুঝতে পেরে সত্যিকার তওবা করে তখন আল্লাহ শুধু তার গুনাহই ক্ষমা করেন না; বরং গুনাহকে নেকি দ্বারা পরিবর্তন করে দেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘কিন্তু যারা তওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের গুনাহগুলোকে নেকি দিয়ে পরিবর্তন করে দেবেন।’ (সুরা ফুরকান: ৭০) জিলহজ অতি মর্যাদাপূর্ণ মাস হওয়ায় মাসের শুরুতেই আন্তরিক তাওবা করে নিজেকে পবিত্র করে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন আলেমরা। 

দান-সদকা
দান-সদকা এমনিতেই গুরুত্বপূর্ণ নেক আমল। কিন্তু বিশেষ দিনে এর গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। তাই জিলহজ মাসে দান-সদকা করা বিশেষ সওয়াবের কাজ ও ফজিলতপূর্ণ আমল। অন্যের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মর্যাদা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা নিজের সম্পদ দিনে বা রাতে প্রকাশ্যে অথবা গোপনে আল্লাহর পথে খরচ করে তাদের পুরস্কার তাদের প্রতিপালকের কাছে আছে। তাদের কোনো ভয় নেই। তাদের কোনো চিন্তাও নেই।’ (সুরা বাকারা: ২৭৪) আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি ব্যয় করো, হে আদম সন্তান! আমিও তোমার জন্য ব্যয় করব।’ (বুখারি: ৫৩৫২)

জিলহজের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর একবার তকবির বলা ওয়াজিব। পুরুষেরা স্বাভাবিক স্বরে, আর নারীরা নিম্ন স্বরে এই তকবির বলবেন। তকবির হলো ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ’। (ইলাউস সুনান, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা: ১৪৮)।