বাজেটে কর্মসংস্থানের দিশা নেই, উদ্যোক্তা হওয়ার অনুপ্রেরণা
সদ্য ঘোষিত বাজেটে বিভিন্ন খাতে কেমন বরাদ্দ দেওয়া হলো বা কতটা কাজে লাগবে বরাদ্দ, তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। এর মধ্যে কর্মসংস্থান তৈরি বা চাকরির বিষয়টি অন্যতম আলোচ্য বিষয়। গত ১ জুন সংসদে পেশকৃত বাজেটে গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য ১০০ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দও রয়েছে বাজেটে। এরইমধ্যে চাকরিপ্রার্থীদের চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ বছর করার দাবির আন্দোলন এ আলোচনায় আরও জ্বালানি যোগাচ্ছে।
জানা গেছে, বাজেট বক্তৃতায় ‘কর্মসংস্থান’ শব্দটি ৬৪ বার এবং ‘চাকরি’ শব্দটি ১২ বার উল্লেখ আছে। এবার বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য নতুন গন্তব্য অন্বেষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির মতো নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। তবে এগুলো যথেষ্ট কিনা, তা নিয়ে নানান মত রয়েছে বিশ্লেষকদের। তারা বলছেন, বাজেটে কর্মসংস্থানের বিষয়ে বরাদ্দ বা উদ্যোগ গতানুগতিক। নতুন কিছু নেই।
বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, সবার জন্য শোভন কর্মসংস্থান নিশ্চিত ও জনশক্তিকে দক্ষ ও শ্রমবাজারের উপযোগী করে তোলা অন্যতম অর্থনৈতিক নীতি কৌশল। ফলে প্রতিবছর শ্রমশক্তিতে ২০ লাখের বেশি মানুষ যুক্ত হচ্ছে, বেকারত্বের হার হ্রাস পাচ্ছে। কর্মসংস্থান কাঠামো এবং দক্ষতা চাহিদার দ্রুত পরিবর্তন বিবেচনায় টেকসই কর্মসংস্থানের উপযোগী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
কর্মসংস্থানের কয়েকটি সুনির্দিষ্ট খাতের কথা উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী। ২০২৫ সালের মধ্যে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা ২০ থেকে বাড়িয়ে ৩০ লাখ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের অদূরে ১ হাজার ১৫০ একর জায়গায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরীতে পাঁচ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ ২০৩০ সালের মধ্যে দুই লাখ লোকের কর্মসংস্থান করবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নয়নশীল দেশে কর্মসংস্থান বাড়াতে সরকারিভাবে সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টির কর্মসূচি নেওয়া হয়। বাংলাদেশে এ ধরনের কর্মসূচির পরিসর কম। করোনাভাইরাস এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কাজের সুযোগ কমে গেছে। এ অবস্থায় কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কর্মসূচি সম্প্রসারণ করা দরকার। তবে বাজেটে তেমন পদক্ষেপ কম। চাকরির সুযোগ না পেয়ে অনেকে উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করছেন। যদিও এতেও নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের রিসার্চ ডিরেক্টর খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, কর্মসংস্থান তৈরির বিষয়টি বাজেটে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি। বেকার বিশেষ করে গ্র্যাজুয়েটদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেই। পুরোনো উদ্যোগগুলোর ধারাবাহিকতার কথা শোনা গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, বর্তমানে দেশে মোট শ্রমশক্তি ৭ কোটি ৩৬ লাখ ৯০ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ ৪ কোটি ৮২ লাখ ৫০ হাজার এবং নারী ২ কোটি ৫৪ লাখ ৪০ হাজার জন। কর্মে নিয়োজিত জনগোষ্ঠী ৭ কোটি ১১ লাখ। বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ ১৭ লাখ ১০ হাজার, নারী ৮ লাখ ৮০ হাজার। শ্রমশক্তির বাইরের জনগোষ্ঠী ৪ কোটি ৬৩ লাখ ৯০ হাজার। শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ৬১. ৩৭ শতাংশ।
বাজেটের অনুযায়ী, যেসব মন্ত্রণালয় কর্মসংস্থান তৈরি ও দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করে তাদের বরাদ্দ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কমেছে। কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দ ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় কমেছে ২৪ শতাংশ। যুব মন্ত্রণালয়ের ২২ শতাংশ ও শিল্প মন্ত্রণালয়ে ৩২ শতাংশ কমেছে। তবে বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৩৯ শতাংশ বেড়েছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর সাবেক পরিচালক (প্রশিক্ষণ) নুরুল ইসলামের মতে, কর্মসংস্থান তৈরির জন্য বরাদ্দের চেয়ে প্রতিটি স্তরের সমন্বিত প্রচেষ্টা বেশি জরুরি। আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে আরও সক্রিয় হতে হবে। বাজেট চাইলেই পাওয়া যায়, কিন্তু উদ্যোগ কম।
আরো পড়ুন: প্রতারণার ফাঁদে অধ্যাপক থেকে পিওন, দেড় কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা কর্মচারী
বাজেট বক্তব্যে দাবি করা হয়েছে, তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার ২ কোটি ৩৫ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। ২০২৩ সালে চাকরির সংখ্যা ৭ কোটি ১১ লাখ ছিল বলে অনুমান দেওয়া হয়েছে।
শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, বাংলাদেশে আগের জরিপের তুলনায় সর্বশেষ হিসাবে কর্মসংস্থানে কৃষির অংশ বেড়েছে এবং শিল্পের অংশ কমেছে। এর অর্থ হলো শিল্প ও সেবা খাতে কাজের সুযোগ সীমিত হয়েছে। বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে বলে মত অর্থনীতিবিদদের।
জানা গেছে, দেশের কর্মসংস্থানের ৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২৮ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এক দশকে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়লেও জিডিপির অনুপাতে তা স্থবির হয়ে আছে। গত চার অর্থবছরে এ হার ২৩ থেকে ২৪ শতাংশ। বাজেটে আগামী অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কর্মসংস্থান খাতবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা ড. রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, এবারের বাজেটে কর্মসংস্থানের বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতিতে এতে বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। শোভন কাজ সৃষ্টিতে বিশেষ নজর না দেওয়ায় বিপুলসংখ্যক মানুষকে কিছু একটা করে জীবিকা অর্জনের চেষ্টা করতে হচ্ছে। এর বড় অংশ দরিদ্র অথবা সীমার কাছাকাছি থেকে যাচ্ছে বলে মত তার।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ছিল ৬ কোটি ৩৫ লাখ। এর মধ্যে কাজে ছিলেন ৬ কোটি ৮ লাখ নারী-পুরুষ, বাকি ২৭ লাখ ছিলেন বেকার।
ডিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, এবারের বাজেটে কর্মসংস্থান তৈরির জন্য বড় উদ্যোগ ও দক্ষতা উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়ানোর আশা ছিল। তবে তা হয়নি। আইটি দক্ষতা উন্নয়নে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের বিষয়টি নতুন, বাকিসব আগের কার্যক্রম চালিয়ে নিতে। এগুলো শুধু দেখানোর জন্যই। বাজেটে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বৃদ্ধির জন্যও কোন উল্লেখযোগ্য সমর্থনের কথা উল্লেখ করা হয়নি।