বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া দরকার: ডোনাল্ড লু
বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। আমাদের কাছে এই দেশটির বিশেষ স্থান রয়েছে। এই দুই দেশের মানুষে মানুষে, পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কম্পানি পর্যায়ে দারুণ সম্পর্ক রয়েছে। আমরা বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র এগিয়ে নিতে চেষ্টা করি। এটি বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনের একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে একটি সত্যিকারের গণতন্ত্র রয়েছে। এ কারণেই এখানে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া দরকার।
বুধবার রাতে চ্যানেল আইয়ের তৃতীয় মাত্রাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু । ওই সাক্ষাৎকার বিবরণী যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস গত রাতেই তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে।
ডোনাল্ড লুর কাছে প্রশ্ন ছিল, কেন যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশিদের জন্য এই নতুন ভিসানীতি চালু করতে যাচ্ছে এবং এটি কি সত্যিই দরকার ছিল? জবাবে লু বলেন, ‘আমি একটি বিষয় খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই যে আজ আমরা কাউকে স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) দিচ্ছি না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেন একটি নতুন নীতির ঘোষণা করেছেন, যা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার সেসব ব্যক্তির ভিসা সুবিধায় বিধি-নিষেধ আরোপ করতে পারবে, বিশেষ করে যারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সুতরাং যে কেউ এর আওতায় পড়তে পারেন, সরকারের লোকজন, বিচার বিভাগের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা বিরোধী দলের কেউ।
লু আরো বলেন, আমরা বিষয়টি এভাবে দেখছি যে দক্ষিণ এশিয়া এবং সারা বিশ্বে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে যেতে হলে বাংলাদেশের জন্য গণতন্ত্র রক্ষার বিষয়টি একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় এবং অপরিহার্য।
ডোনাল্ড লুর কাছে আরো প্রশ্ন ছিল, দেশের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং অন্য বাংলাদেশিদের কিভাবে এই নীতির আওতায় আনা হবে? আপনি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কথা উল্লেখ করেছেন- সরকারের কোনো সদস্য কি এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত? জবাবে লু বলেন, এই নীতিটি সরকারের এবং বিরোধী দলের সবার জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, সামনের নির্বাচনে যদি আমরা দেখি যে বিরোধী দলের কেউ সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছেন বা ভোটারদের ভয় দেখিয়েছেন, তাহলে সেই ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবেন না। একইভাবে যদি আমরা দেখি যে সরকারের বা নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কেউ যদি ভোটারদের ভয় দেখায় অথবা সহিংসতায় জড়ায় অথবা বাকস্বাধীনতাকে অগ্রাহ্য করে, তবে সেই ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।
গণমাধ্যম, ইন্টারনেট সেবাদানকারী সংস্থা বা অন্য যেকোনো সংস্থা, এমনকি মোবাইল ফোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান পড়বে কি না জানতে চাইলে ডোনাল্ড লু বলেন, ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ করে না।
এটি প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়। এটি শুধু ব্যক্তিদের জন্য।
ডোনাল্ড লুর কাছে প্রশ্ন ছিল, জড়িত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরাও কি ভিসা বিধি-নিষেধের এই নীতির আওতায় পড়বেন? জবাবে লু বলেন, হ্যাঁ। নতুন এই নীতি এবং যে আইনটির ওপর ভিত্তি করে এটি নেওয়া হয়েছে। উভয় জায়গাতেই এই বিষয়টি খুব স্পষ্ট।
অভিযুক্ত ব্যক্তির কাছে পরিবারের সদস্যরা-অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী এবং সন্তানরাও এই নীতিতে ভিসা বিধি-নিষেধের সম্মুখীন হবেন।
যাদের ভিসা বাতিল করা হয়েছে তাদের জানানো হবে কি না—এ প্রশ্নের জবাবে ডোনাল্ড লু বলেন, ভিসা বাতিল করার সঙ্গে সঙ্গেই সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি জানানো হবে।
সুনির্দিষ্টভাবে কাদের এই বিধি-নিষেধের আওতায় আনা হবে?—জানতে চাইলে লু বলেন, আবারও বলছি, আমরা শুধু পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেনের অনুমোদন দেওয়া একটি নতুন নীতির বিষয়ে সবাইকে অবহিত করছি। এটি এখন পর্যন্ত নির্দিষ্ট কারো ওপর প্রয়োগ করা হয়নি। এই নীতি আমাদেরকে এ রকম যেকোনো ব্যক্তির যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণে বিধি-নিষেধ আরোপে সহায়তা করবে, যারা এই চারটি কাজের যেকোনো একটিতে জড়িত থাকবেন : ভোটারদের ভয় দেখানো, ভোট কারচুপি, বাকস্বাধীনতাকে অগ্রাহ্য করা বা সমাবেশ করার অধিকারকে অগ্রাহ্য এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যাহত করতে সহিংসতার ব্যবহার।
লু আরো বলেন, ‘আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, সরকার ও বিরোধীদের উভয়ের ক্ষেত্রেই ন্যায্যতার ভিত্তিতে, গঠনমূলক পদ্ধতিতে এবং সমানভাবে এই নীতির বাস্তবায়ন করা হবে।’
ডোনাল্ড লু বলেন, নির্বাচনের সময় যুক্তরাষ্ট্র সরকার কখনোই কোনো পক্ষ নেয় না। আমরা কোনো বিশেষ দল বা কোনো বিশেষ প্রার্থীকে সমর্থন করি না। একটিমাত্র বিষয়কেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার সমর্থন করে, আর তা হলো একটি অবাধ ও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া।
যারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদেশ বাস্তবায়ন করে থাকেন, তাদের ওপর এই নীতি প্রযোজ্য কি না জানতে চাইলে ডোনাল্ড লু বলেন, আদেশদাতা এবং আদেশ কার্যকর করা—উভয়েই এই শাস্তির আওতায় আসবে। যারা আদেশ গ্রহণ করে সহিংসতা বা ভোটারদের ভয়ভীতি বা ভোট কারচুপির কাজ করবে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। একইভাবে যারা এসব কাজের নির্দেশ দেবেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ করতে পারবেন না।
প্রশ্ন ছিল, গত ১৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের নিরাপত্তা (ট্রাফিক এসকর্ট) কমিয়ে আনার ঘটনার জেরেই কি এই নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে? জবাবে ডোনাল্ড লু বলেন, ‘বিষয়টি একেবারেই এ রকম না। গত ৩ মে বাংলাদেশ সরকারকে যখন নতুন এই নীতির বিষয়ে অবহিত করা হয়, তখন আমি ব্যক্তিগতভাবে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। সুতরাং নতুন এই নীতি এবং এর ঘোষণা কোনোভাবেই সরকারের ১৪ মে এর ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। যুক্তরাষ্ট্র সরকার কখনো প্রতিশোধের মনোভাব নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় না এবং নেবে না।’
অতীতের কতদূর পর্যন্ত নতুন এই নীতি কার্যকর হবে—জানতে চাইলে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি লু বলেন, ‘এটি একটি ভবিষ্যৎমুখী নীতি। বাংলাদেশে আগামী দিনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে এবং সহিংসতা প্রতিরোধে সহায়তা করবে বলে আমরা আশা করছি। আমরা এই দায়িত্বটি খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে থাকি এবং আমরা পেছনে ফিরে তাকাতে চাই না।’ তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে বাংলাদেশের বন্ধু মনে করে। আমরা নতুন এই নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, তাঁর সরকার, বাংলাদেশি নাগরিক সমাজ ও বাংলাদেশের জনগণের যে চেষ্টা তাকে বেগবান করতে চাই- এটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
বাংলাদেশের নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ জানতে চাইলে ডোনাল্ড লু বলেন, বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। আমাদের কাছে এই দেশটির বিশেষ স্থান রয়েছে। এই দুই দেশের মানুষে মানুষে, পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কম্পানি পর্যায়ে দারুণ সম্পর্ক রয়েছে। আমরা বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র এগিয়ে নিতে চেষ্টা করি। এটি বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনের একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে একটি সত্যিকারের গণতন্ত্র রয়েছে। এ কারণেই এখানে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া দরকার।
ডোনাল্ড লু বলেন, আমি জানি, নতুন এই নীতিটি অনেক প্রশ্ন তৈরি করবে। আমি আবারও জোর দিয়ে বলতে চাই, আমরা এই সিদ্ধান্তটি সবচেয়ে গঠনমূলক এবং ইতিবাচক উপায়ে নিয়েছি। আমরা চাই, এটি বাংলাদেশে সংলাপ এবং আগামী বছরে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকার, বিরোধী দল, নাগরিক সমাজ—সবার প্রচেষ্টায় অবদান রাখবে।
তিনি বলেন, ‘সামনের সময়টি বাংলাদেশের জন্য কঠিন হতে পারে। অথবা এই সময়টি সত্যিই একটি আনন্দময় যুগের সূচনা করতে পারে, যেখানে বাংলাদেশ তার সমস্ত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অর্জন উদযাপন করবে, এমন একটি নির্বাচন করে, যা আগের সব নির্বাচনের চেয়ে ভালো। এটাই আমাদের আশা।’