সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সঙ্গে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করতে হবে: ড. খলীকুজ্জমান
অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন চিন্তাবিদ ও জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান বলেছেন, দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর টেকসই উন্নয়ন এবং মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে।
বুধবার (২৯ মার্চ) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন ওয়েভ ফাউন্ডেশনের আয়োজনে ‘সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির নীতিগত সংস্কার সম্পর্কিত পলিসি কনফারেন্সে’ সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
ড. কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি বিশাল এ জনগোষ্ঠীর কর্মমুখী দক্ষতা উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। যার মাধ্যমে সমাজে বৈষম্য কমে আসবে এবং ভারসাম্য তৈরি হবে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, আলোচনায় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির যে সমস্যাগুলো উঠে এসেছে তার মূলে রয়েছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিজনিত সমস্যা। এছাড়া কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়নে সঠিক যে তথ্য-উপাত্ত দরকার তার জন্য বিবিএসের উপর আমাদের নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। তবে, এত বড় মাপের কর্মসূচি বাস্তবায়নে সঠিক জনবলের যথেষ্ট অভাব রয়েছে, তাই যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় সংখ্যক সমাজকর্মী নিয়োগ দিতে হবে।
অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আসিফ শাহান বলেন, আমাদের বর্তমান জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নানাবিধ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। জাতীয় বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এ খাতে ব্যয় করা হলেও কর্মসূচিসমূহের প্রকৃত প্রভাব প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। এ অবস্থা নিরসনে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ব্যয়িত অর্থের দক্ষতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর মাধ্যমে সরকার দেশের অতি-দরিদ্র ও সর্বাধিক ঝুঁকিগ্রস্ত নাগরিকদের ন্যূনতম আয়ের নিশ্চয়তা প্রদান করতে চায়; একই সাথে সুরক্ষিত রাখতে চায় দারিদ্র্যে নিপতিত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে।
তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির উত্তরণে এনএসএসএস নিঃসন্দেহে ভাল কৌশল। তবে কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগীদের বাছাই প্রক্রিয়া সুষ্ঠু নয়। এছাড়া সুবিধাসমূহ বণ্টনে অনিয়ম ও অপব্যবহার রয়েছে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অধীনে বাস্তবায়নাধীন এ সকল কার্যক্রমের যথাযথ মনিটরিং হয় না; পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ের পরে উপকার-ভোগীদের অবস্থার মূল্যায়ন এবং মূল্যায়নের প্রেক্ষিতে পরবর্তী পরিকল্পনা প্রণয়নেরও তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বা ব্যবস্থা নেই। ফলে কত মানুষের দারিদ্র্যাবস্থার উন্নয়ন হলো বা হলো না, তারও কোনো যথাযথ বা সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
আলোচনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শারমিন্দ নিলোর্মী বলেন, সঠিক তথ্যের মাধ্যমে ডিজিটাল ডাটাবেজে যোগ্য সুবিধাভোগী নির্বাচনে সরকারের বিবিএসের সহায়তা নিতে হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ইনডিকেটর ধরে যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে বিবিএস এর সহায়তা আরও বেশি নেয়া প্রয়োজন।
সভায় বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) রিসার্চ ডিরেক্টর ড. মাহফুজ কবীর বলেন, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি গ্রাম ভিত্তিক হওয়ায় নগর দরিদ্র বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা প্রমাণ করে আমাদের কাঠামোগত সমস্যা রয়েছে। সরকারে কর্মসূচিগুলোতে বরাদ্দ বেড়েছে ঠিকই তবে বণ্টনে তথ্যের অভিগম্যতা, সঠিক সুবিধাভোগী নির্বাচন এবং মনিটরিং ব্যবস্থায় আমাদের চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
আর আয়োজকদের পক্ষে বক্তব্য প্রদান-কালে ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী বলেন, করোনা পরবর্তী সময়ে আমরা সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বিষয়ে অধিক সচেতন হয়েছি। সঠিকভাবে সুবিধাভোগী নির্বাচনে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আজকের পলিসি কনফারেন্সে যে মতামতগুলো উঠে এসেছে এগুলো সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে তুলে ধরা প্রয়োজন। কর্মসূচির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে ডাটাবেস তৈরি, বণ্টন ব্যবস্থার পর্যবেক্ষণ এবং এনএসএসএস-এর সামগ্রিক কার্যক্রমের সমন্বয়ক হিসেবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব প্রদানের কথা উল্লেখ করেন।
বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন ওয়েভ ফাউন্ডেশন ‘একটি ন্যায্য ও সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠার’ সংকল্প নিয়ে বিগত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে নানামুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় দায়বদ্ধ ও জবাবদিহিমূলক এবং স্বচ্ছ সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা এবং অনুশীলনগুলো শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সংস্থা দি এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহযোগীতায় চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা ও আলমডাঙ্গা উপজেলা এবং মানিকগঞ্জ জেলার মানিকগঞ্জ সদর ও শিবালয় উপজেলায় ‘সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে নাগরিকদের দাবি উত্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সংস্থাটি।
প্রকল্পটি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির (এসপিপিএস) সুশাসন বৃদ্ধিতে নাগরিকদের পর্যালোচনা, পর্যবেক্ষণ, মনিটরিং, লবি এবং এডভোকেসিতে নাগরিক সমাজের সম্পৃক্ততা বাড়াতে এবং এসপিপিএস কর্মসূচিতে মানুষের অধিকার আদায়ে কমিউনিটি সচেতনতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট নীতিমালার চাহিদা মাফিক সংস্কার করতে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করছে ওয়েভ ফাউন্ডেশন।