০৬ মার্চ ২০২৩, ১১:২৬

ইংরেজি পারেন না স্নাতকের শিক্ষার্থীরাও, দুর্বলতা কোথায়?

ইংরেজি পারেন না স্নাতকের শিক্ষার্থীরাও  © সংগৃহীত

বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী এখনও ইংরেজি বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে আছে। জন্মের পর আমাদের কথা বলা শিখতে মোটামুটি ৩/৪ বছর লাগে। ভাষার ব্যাকরণ না জানা সত্ত্বেও আমরা অনর্গল মাতৃভাষায় কথা বলতে পারি। এ ব্যাকরণ না জানাটা মাতৃভাষা বলতে বাধার সৃষ্টি করে না। আবার দেখা যায় ছোট থেকেই হিন্দি বা ইংরেজি কার্টুন দেখে দেখে হিন্দি বা ইংরেজিতে পারদর্শী হয়ে উঠেছে।

অন্যদিকে একজন অনার্স-মাস্টার্স পাস করা শিক্ষার্থী প্রায় ১৭-১৮ বছর ইংরেজি চর্চা করেও ইংরেজিতে কথা বলা বা লেখায় দক্ষ হতে পারছেন না। পারলেও সবার সামনে বাংলা যেমন সুন্দর ও সহজ ভঙ্গিমায় বলছে ঠিক তেমন পারছে না। সংশ্লিষ্টদের মতে, এর উত্তর পাওয়া যাবে কিছু প্রশ্নের মধ্যে। আমরা কীভাবে ইংরেজি শিখছি বা পড়ছি? আমরা কি নিয়মিত কথা বলার জন্য পড়ছি? নাকি পরীক্ষায় নাম্বার পাবার জন্য শুধু ব্যাকরণের নিয়ম পড়ছি?

শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমরা প্লে গ্রুপ থেকেই ইংরেজি পড়া শুরু করেছি। আমরা আমাদের অতীতে তাকালে দেখতে পারবো, সেই শিশু অবস্থায় আমরা বিভিন্ন জিনিসের নাম ইংরেজিতে শিখতাম। ফুল, ফল, গাছ, নদী বা খুব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রকে ইংরেজিতে কি বলে সেগুলো শিখেছি। আরেকটু বড় হলে আমরা ছোট ছোট ট্রান্সলেশন, ব্যাকরণ আর প্যারাগ্রাফ লিখতে শিখেছি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের হলেও সত্য যে সেগুলা সবই আমরা মুখস্থ করতাম পরীক্ষায় নাম্বার পাওয়ার জন্য, শেখার জন্য না। তাছাড়া আজীবন গ্রামার পড়ে সে খাতায় সুন্দর লিখতে পারলেও পারবে না নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ইংরেজিতে কথা বলতে।

এই অজানা ইংরেজি স্কুল জীবনে আস্তে আস্তে একটা বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় আমাদের সামনে। আমরা ভাবতে থাকি, 'এখনো পারি না, কেউ জানলে মানসম্মান শেষ।' ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে এভাবেই লোকলজ্জার ভয়ে আমরা কাউকে না পারি বলতে, না পারি সহজে শিখতে। যখন একজন শিক্ষার্থী কলেজ পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পণ করে, তখন সে দেখে তার ইংরেজিতে দুর্বলতা। কিন্তু একজন ভার্সিটি পড়ুয়া শিক্ষার্থী ইংরেজি পারে না সে-ই কথাটা সে লজ্জায় কাউকে বলতেও পারে না।

আবার শেখার জন্য পড়া শুরু করতে পারে না। পরে দেখা যায় শুধু ইংরেজি শেখার জন্য তাকে বিভিন্ন কোচিং-এ ভর্তি হতে হয়। কোচিং-এ মাত্র ৩/৬ মাস কোচিং করলেই দেখা যায় সে ইংরেজিতে দক্ষ হয়ে উঠেছে। অথচ সে এই যে গত ১৭/১৮ বছর ইংরেজি পড়লো, কেন সে সহজে ইংরেজিতে কথা বলা শিখতে পারলো না! এটাকে আমরা  দুর্বলতা বা ব্যার্থতা যা-ই বলি না কেন, এর দায় কার ঘাড়ে বর্তাবে!


এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী ওমর ফারুক বলেন, এখানে প্রথম দুর্বলতাটা আমাদের পাঠ্য-পুস্তক সিলেবাসের। এখানে কোন চ্যাপ্টার ভিত্তিক প্রেজেন্টেশন এর বাধ্যবাধকতা নাই, যেটা পরীক্ষায় নম্বর যুক্ত করে। দ্বিতীয়ত ইংরেজি বলায় দক্ষ শিক্ষকের অভাব। তৃতীয়ত ছাত্রদের শুধু পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের লক্ষ্য যা তাদের স্পিকিং এ দক্ষ হওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহী করে না। যার ফলে একজন শিক্ষার্থী 'ছয়' বছর বয়স থেকে ইংরেজি শিক্ষা চালিয়ে গেলেও ইংরেজি বলায় পারদর্শী হয়ে উঠছে না।

মি. ইংলিশ (ইংলিশ & ক্যারিয়ার) কোচিং-এর শিক্ষক ও ঢাবি লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী সোহানা কানন অনন্যা বলেন, ইংরেজি শিখতে না পারার মূল কারণ হচ্ছে তা ব্যাবহার না করা। ইংরেজি একটা ভাষা। কিন্তু আমরা এটিকে বই-পুস্তকে গ্রামার হিসেবে শিখি। আমরা জানি, যেকোনো ভাষা শিখার ৪ টি ধাপ রয়েছে। 1. Listening 2. Speaking 3. Reading 4. Writing

আমরা বাংলা ভাষা প্রথমে শুনেছি। তারপর বলার চেষ্টা করে শিখেছি। বইয়ে পড়েছি ও লিখেছি। কিন্তু ইংলিশের ক্ষেত্রে আমরা যে দুই টা শুরুতে করা দরকার সেই দুইটা (Listning & speaking) বাদ দিয়ে স্কুল-কলেজ ও ভার্সিটি লাইফ শেষ করি। তাই সহজেই আমরা ইংরেজিতে কথা বলতে পারি না।

ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আমাদের প্রথমেই নজরে রাখতে হবে আমরা নিজের মাতৃভাষা বাংলা ভালোভাবে পারি কি-না! নিজ ভাষা শুদ্ধভাবে আয়ত্ত করতে পারলে অন্য ভাষা জানা বুঝা ও বলাটা সহজ হয়। তাছাড়া আমাদের পাঠ্যক্রম, সিলেবাস যথেষ্ট উপযুক্ত নয়, ফলে শিক্ষার্থীরা এতদিন ধরে ইংরেজি পড়লেও শুদ্ধ-ভাবে বলতে বা লিখতে পারে না।

তাছাড়া শিক্ষার্থীদের ইংরেজি না পারার সবচেয়ে বড় কারণ হলো দক্ষ শিক্ষকের অভাব, আমাদের স্কুল লেভেলের শিক্ষকরা শুদ্ধ ইংরেজিতে কথা বলতে না পারায় শিক্ষার্থীরাও শিখতে পারে না। তাছাড়া স্কুল লেভেলে দক্ষ শিক্ষকের অভাব আমরা টারশিয়ারি লেভেলে আসলে স্পষ্ট লক্ষ করতে পারি। আমরা প্রাইমারি ও হাইস্কুল লেভেলে মানসম্মত পাঠ না পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা বড় হয়ে লোকলজ্জার ভয়ে আর পেরে উঠে না।

ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসাদ মোর্তজা বলেন, প্রথমত আমাদের সমস্যা শিক্ষাব্যবস্থায়। তারচেয়ে বড় সমস্যা আমাদের দক্ষ স্কুল লেভেলে দক্ষ শিক্ষকের অভাব। আমরা যখন প্রাইমারী শিক্ষকদের ৮/১০ হাজার টাকা বেতন দিবো, তখন তাদের কাছে ভালো শিক্ষা চাওয়াটা বোকামি। দক্ষ শিক্ষকগণ অল্প টাকায় শিক্ষকতা করবেন না। ফলে প্রাথমিক লেভেলে শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা পায় না। 

ভার্সিটি লেভেলে আলাদা ইংরেজি ভাষা শিক্ষা প্রয়োজন কি-না প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা ভালো একটা পদ্ধতি হতে পারে। একজন শিক্ষার্থী চান্স পাবার পরে মূল ক্লাস শুরুর আগে ৬ মাস ভাষা শিক্ষা ও কম্পিউটার শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলে সে বেসিক ট্রেনিং পেয়ে যায়, ফলে শহুরে ও গ্রামের শিক্ষার্থীদের মাঝে ব্যবধান দূর হবে। এতে কারোর ভার্সিটির পাঠক্রমে কারো সমস্যা হবে না এবং অন্তর্জাতিক মানের শিক্ষার্থী হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে।

আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. অবসর কামাল বলেন, আমরা আমাদের প্রাইমারি ও হাইস্কুলে একই গ্রামার বই প্রতি বছর কিনে পড়ি। ফলে ইংরেজি গ্রামারটা আমাদের জন্য অনেক কষ্টদায়ক মনে হয় এবং পড়ায় অনীহার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া আমরা স্কুল লেভেলে শুধু গ্রামার বা প্যারাগ্রাফ লিখা শিখি, ফলে আমরা শুদ্ধ-ভাবে বলতে পারিনা।

অন্যদিকে আমাদের শিক্ষকরা আমাদের মানসম্মত শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়। ফলাফল হিসেবে আমরা গোড়া থেকেই ইংরেজিতে দুর্বল হিসেবে গড়ে উঠি। আমাদের শিক্ষাক্রম আমাদের ইংরেজি গ্রামার শিখতে বললেও প্রেজেন্টেশন বা সুন্দর করে ইংরেজি বলাকে জোর দেয় না। ফলে শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছায় উদ্যোগী হয়ে ইংরেজি ভাষা রপ্ত করতে চায় না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি স্পোকেনের বাধ্যতামূলক কোর্স থাকবে কিনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি মনে করি বাধ্যতামূলক না করে সেখানে নন ক্রেডিট কোর্স হিসেবে থাকতে পারে৷ সেক্ষেত্রে বিভাগ বলবে তুমি কোর্স করো, নাহলে তুমি মাস্টার্সে ভর্তি হতে পারবে না কিন্তু কোর্সের উপরে কোন ক্রেডিট না থাকায় রেজাল্টে যুক্ত হবে না। ফলে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হয়ে গড়ে উঠতে পারবে।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তনের পাশাপাশি আমাদের দক্ষ শিক্ষক নিয়োগী সেই শিক্ষকদের পর্যাপ্ত সম্মানীর ব্যবস্থা করে যেনো শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের শুধু ভালো রেজাল্ট দেয়া নয় বরং গুণগত শিক্ষা প্রদান করে মানসম্মত শিক্ষার্থী হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের উচিত স্ব প্রণোদিত হয়ে ইংরেজিকে শুধু এ+ পাবার জন্য পড়া নয় বরং এটি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা যা আমাদের আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষার্থী হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে সেভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে। তাহলেই ইংরেজি ভাষাকে আমাদের কষ্টদায়ক লাগবে না এবং শিখতেও বেশ আগ্রহের সৃষ্টি হবে।