যেই শিশুরা বই তৈরী করে তারাই পাচ্ছে না পড়ার সুযোগ
রাজধানীর বাংলাবাজার, সূত্রাপুর, বেলীদাস রোড, পাতলা খান লেনসহ পুনার ঢাকার ছাপাখানা অধ্যুষিত এ এলাকার প্রায় প্রতিটি ছাপাখানাই দেখা মিলবে শিশুদের, যারা শিশুশ্রমে নিযুক্ত। প্রাথমিকের গন্ডি পার না হতে পারা এসব শিশুর বয়স ১০ থেকে ১২ বছর। বই বাধাঁই, মেশিনে যোগান দেওয়া, বই আনা-নেয়া, ছাপাখানার মেশিন পরিচালনাসহ প্রায় সকল কাজই করতে দেখা যায় শিশুদের। যে বয়সে এসব শিশুদের বই পড়ার কথা ,সে বয়সে তারা বই তৈরি করছে। এ যেন বাতির নিচটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন, বই তৈরি করলেও বই পড়ারই সুযোগ পাচ্ছে না এসব শিশুরা।
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ, বাংলাদেশের শিশু আইন-১৯৭৪, জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ-১৯৮৯, শিশু আইন-১৯৭৪, বাংলাদেশের র জাতীয় শিশু নীতি এবং শিশু একাডেমী অধ্যাদেশ-১৯৭৬ সহ বাংলাদেশে চলমান সকল অধিকার সনদে ১৪ বছরের নিচে শিশু শ্রমকে নিষিদ্ধ এবং নিরুতসাহিত করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে শতভাগ শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে আর কতো সময় লাগবে? প্রায় চার দশক তো কম সময় নয়, তাহলে প্রতিশ্রুতিরিই বা কী দরকার ছিলো?
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ছাপাখানার বিভিন্ন কাজে শিশুরা সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বড়দের সমান সময় কাজ করছে। আর্থিক অনটনে ও পেটের দায়ে অনেকটা বাধ্য হয়েই এসব শিশুরা এখানে কাজ করছে। ছোট ছোট নানা কাজের পাশাপাশি ছাপাখানায় শিশুরা মেশিন চালনার মতো বড় ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। তবে, বড়দের সমান সময় ধরে কাজ করলেও তারা বড়দের সমান মজুরি পাচ্ছে না। এখানকার রিসেন্ট পাবলিকেশন, কে. টি বাইন্ডিং, শাহজালাল বাইন্ডিং, নিউ সুজন আর্ট প্রেস, আল মিশর আর্ট প্রেস, সিংগাইর অফসেট প্রির্টিং, নিউ সোনালী প্রিন্টার্সসহ প্রায় সকল ছাপাখানা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে শিশু শ্রমিক রয়েছে।
আরও পড়ুন: যেসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবচেয়ে বেশি নোবেলজয়ী
জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের অনুচ্ছেদ ২৮ অনুযায়ী শিশুর শিক্ষা লাভের অধিকার নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র। তাতে বলা হয়েছে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্র সমান সুযোগের ভিত্তিতে শিশুর শিক্ষা লাভের অধিকারকে স্বীকার করবে এবং এই অধিকারকে অধিক বাস্তবায়নের জন্য গ্রহণ করবে। বিশেষ করে, সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং সহজলভ্য করা হবে যার অন্যতম অগ্রাধিকার। সেজন্য, সাধারণ ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাসহ বহুমুখী মাধ্যমিক শিক্ষাকে উত্সাহ দেয়া, প্রতিটি শিশুর জন্য এইরূপ শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করাও হবে সনদের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বাংলাদেশ জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষর করে ১৯৮৯ সালে।
একইসাথে, সকল শিশু যেন এ সুযোগ লাভ করতে পারে সে জন্য বিনা খরচে শিক্ষা লাভ ও প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্যের উপযুক্ত ব্যবস্থা করবে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্র। পাশাপাশি, শিক্ষা বিষয়ক ও বৃত্তিমূলক তথ্য এবং দিক নির্দেশনা সব শিশুর জন্য সহজে গ্রহণযোগ্য ও পর্যাপ্ত এবং বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিতি উত্সাহিত করা এবং স্কুল ত্যাগের হার কমানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথাও বলা হয়েছে এই সনদে।
একটি প্রেসে কর্মরত শিশু শাকিল দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, তার বাড়ি টাঙ্গেইলে। তিনি দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তিনি এখানে সকাল ৮টা থেকে কাজ করে ২০০ টাকা পান। শাকিল জানান, পড়াশোনার ইচ্ছে থাকলেও তার ও তার পরিবারের সে সামর্থ না থাকায় পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়নি তার।
আরেক শিশু মো. মুসলিম বলেন, তারা ছাপাখানায় বড়দের সমান সময় কাজ করলেও তাদের সমান অর্থ পান না। তবে তিনি জানান, উপযুক্ত সুযোগ ফেলে তিনি আবারও বিদ্যালয়ে ফিরতে চান।
বাগেরহাট থেকে আসা আরেক শিশু ফয়সাল জানান, কাজের জন্যই পড়াশোনা বাদ দিয়ে তিনি ঢাকায় এসেছেন। এখানে কাজ করে যা টাকা পান, তা থেকে নিজের খরচ বাদ দিয়ে বাকী টাকা বাড়িতে পাঠান। তিনি আরও জানান, তার মতো এখানে অনেক শিশু নানা কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
শিশু শ্রমিকদের কাজে নিযুক্ত করার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রেস মালিকরা কথা বলতে রাজি হননি। অনেক চেষ্টার পর মুন প্রিন্টিং প্রেসের ম্যানেজার তরিকুল ইসলাম ওয়াদুদ ডেইলি ক্যাম্পাসের সাথে কথা বলতে রাজি হন। তিনি জানান, তাদের প্রেসে অপ্রাপ্তবয়ষ্ক কোন শ্রমিক নেই। তিনি আরও বলেন, যেসব প্রেসে শিশুদের কাজে যুক্ত করা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ।
বাংলাবাজার পুস্তক ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য গণেষ চন্দ্র ঘোষ জানান, শিশুদের সঠিক মজুরি দেওয়া হচ্ছে না। পাশাপাশি তাদের সুন্দর আগামী নিশ্চিতে শিশুদের অল্পবয়সে শ্রমে নিযুক্ত করা বন্ধ করা উচিৎ।
জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ বলছে, ১৮ বছর বয়সের নিচের কোনো শিশুকেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে (যেমন, সেসব কাজ যা তাদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা বা নৈতিকতার ক্ষতি করতে পারে) সম্পৃক্ত করা বা বাজে ধরনের শিশুশ্রম, উদাহরণস্বরূপ পাচার, যৌননিপীড়ন, ঋণের দায়ে বন্ধক রাখা, জোরপূর্বক শ্রমদানে বাধ্য করা এবং নিরাপত্তা বা সামরিক উদ্দেশ্যে কমবয়সী শিশুদের নিয়োগ বা ব্যবহার করা যাবে না।
ইউনিসেফের তথ্য বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪৭ লাখ। যাদের শতকরা ৯৩ ভাগ শিশুশ্রমিক অনানুষ্ঠানিক খাতে যেমন ছোট কারখানা এবং কর্মশালা, রাস্তায়, গৃহ ভিত্তিক ব্যবসা এবং গার্হস্থ্য কর্মসংস্থানে নিযুক্ত। আর এদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু।
অন্যদিকে, সরকারের হিসেব বলছে, বাংলাদেশে শিশু শ্রমিক রয়েছে ৩৪ লাখ ৫০ হাজার এবং তার প্রায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার শিশুর কাজ শিশুশ্রমের আওতায় পড়েছে এবং বাকি শিশুদের কাজ অনুমোদনসাপেক্ষ। পাশাপাশি, দেশে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ নিয়োজিত রয়েছে ২ লাখ ৬০ হাজার শিশু। অবশ্য সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে ৩৮টি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমকে নির্ধারণ করে সেগুলোকে বন্ধ করার অঙ্গীকার করেছে।