নবীন ও প্রবীণ ভাবনা: কাঙ্ক্ষিত জনশক্তি তৈরি হচ্ছে তো?
দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তাহলে পরিবর্তিত সমাজ কাঠামো অর্থাৎ একটি প্রবীণ সমাজকে পরিচালিত করার মতো দক্ষতা তরুণদের তৈরি হচ্ছে তো? আগামীকে সুরক্ষিত করার জন্য আমরা দক্ষ জনশক্তি আমরা তৈরি করছি তো?
'পরিবর্তিত বিশ্বে প্রবীণ ব্যক্তির সহনশীলতা' প্রতিপাদ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব প্রবীণ দিবস। সরকারের তথ্য বলছে, বর্তমানে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার। তারা দেশের মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ বলছে জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২ এর প্রতিবেদন। এ হার ছিল ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ ছিল ২০১১ সালের জনশুমারিতে।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা উন্নয়ন তহবিলের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০২৫-২৬ সালে প্রবীণের সংখ্যা হবে ২ কোটি। ২০৫০ সালে এ সংখ্যা দাঁড়াবে সাড়ে ৪ কোটি, যা তখনকার জনসংখ্যার ২১ শতাংশ হবে।
গত পাঁচ দশক আগে বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, কোরিয়া, চায়না এ-সব দেশ উন্নয়নের সূচকে বাংলাদেশের সমপর্যায়ের ছিল। কিন্তু, কতটা মৌলিক এবং বাস্তবিক পরিবর্তন হয়েছে আমাদের শিক্ষাখাতে? প্রচলিত শিক্ষা ভূমিকা রাখতে পারছে তো আমাদের তরুণদের আগামীর জন্য যোগ্য, দক্ষ, প্রযুক্তিসম্পন্ন ও সাহসী করে গড়ে তুলতে?
এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো ইতিবাচক ধরা যাচ্ছে না। কেননা, জাপান কিংবা চায়না অথবা মালয়েশিয়ায় আমার সমবয়সী একজন তরুণ আমাদের তরুণদের ছাড়িয়ে গেছে শিক্ষা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতায়। শিক্ষায় মোট জিডিপির ৬ শতাংশ খরচ করার কথা থাকলেও করা হচ্ছে ২ দশমিক ৮ শতাংশ। পুরো স্বাস্থ্যখাত স্পষ্টত তরুণদের জন্য উপযুক্ত ও যথাযথ নয়। এখাতে খরচ করা হয় জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৮৯ শতাংশ। যা প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন খরচ। এরমধ্যেও অপচয় ও দুর্নীতির কারণে এর সম্পূর্ণ সুফল নাগরিকদের কাছে পৌঁছাতে পারছে না।
তরুণদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা তো আরও নাজুক। এমন অবস্থায়, স্বাধীনতার পাঁচ দশকে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার সব প্রস্তুতি বেশ ভালোই এগিয়ে চলছে। সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক আগ্রহ ও উদ্যোগ লক্ষণীয় হচ্ছে। সময়ের সাথে যার প্রয়োজনও অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু এরকম একটি সময়ে আমাদের জনমিতিতে যে পরিবর্তন হচ্ছে, তার সুফল ভোগ করতে হলে আমাদের বর্তমান তরুণদের জন্য বিনিয়োগ করতে হবে পরিবর্তনের সুফল পেতে হলে।
আরও পড়ুন: ফুল-ফ্রিতে স্নাতকোত্তর করুন নরওয়েতে
কেননা ২০২৯ সালে বয়োবৃদ্ধ অর্থাৎ ৭ শতাংশ মানুষ প্রবীণ ও ২০৪৭ সম্পূর্ণ অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ প্রবীণ তথা আমাদের সমাজ পরিণত হবে প্রবীণ সমাজে। আর ২০৫০ সালে এ সংখ্যা দাঁড়াবে সাড়ে ৪ কোটি, যা তখনকার জনসংখ্যার ২১ শতাংশ হবে। জনমিতিতে এমন পরিবর্তনে আজকের তরুণ প্রজন্মকে সে সময়ের সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে বর্তমানের তুলনায় ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি দক্ষ হতে হবে।তাই তরুণদের দক্ষ ও যুগোপযোগী করতে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, পুষ্টি, সামাজিক নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতামূলক খাতসমূহের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী খাতে। এছাড়াও, বিনিয়োগে লক্ষ্য রাখতে হবে শহর কিংবা গ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চল এককথায় সকল তরুণরা যেন সমান অংশীদার হওয়ার সুযোগ পায়।
তাহলেই, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, ডিজিটাল ও উচ্চ আয়ের বাংলাদেশের সুফল খুব সহজেই আত্মস্থ করা যাবে। বিনিয়োগের জন্য এসব খাত অতি গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যক, কেননা তরুণদের দক্ষতা ও সাফল্যের মাধ্যমেই বড় পরিবর্তন সাধিত হবে আগামীতে। সেক্ষেত্রে, সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের এমন ভাবার কোনো সুযোগ নেই যে, বিনিয়োগ করতে পারলেই হলো। বরং, বিনিয়োগ ও পরবর্তী সুফলের জন্য পরিকল্পনা ও এর যথাযথ বাস্তবায়ন দক্ষতার প্রমাণও দিতে হবে একইসময়ে।
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সামগ্রিক পরিকল্পনায় আমাদের সরকারি ও বেসরকারি এমন উদ্যোগ নিতে হবে যেন কোন তরুণ অদক্ষ হয়ে বেড়ে না ওঠে। যা, জাপান করেছে এবং এর সুফল তারা এখন পাচ্ছে। তারা, বিগত সময়ে নারী, শিশু ও তরুণদের জন্য বিনিয়োগ করেছে এবং বর্তমানে যা হয়েছে তা স্পষ্ট। কিন্তু, হতাশার খবর হচ্ছে, আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য কিংবা প্রযুক্তি খাতে শিশুদের জন্য বর্তমান বিনিয়োগ দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় সবচেয়ে কম।
তাই, প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে আমাদের একটিই করনীয় দক্ষতা উন্নয়নে বড় বিনিয়োগ ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন। সেজন্য, সবার আগে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। নীতি ও সিদ্ধান্ত সরকারের ইচ্ছার উপরই বেশি নির্ভরশীল। তাই সরকার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের আর দেরি করার সুযোগ নেই। এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা আমাদের শিশুদের জন্য কী করবো? কতটা দক্ষ করে তাদের আগামীর জন্য গড়ে তুলবো।
এছাড়াও নৈতিকতা ও সফট স্কিলস্ বাড়াতেও কাজ করতে হবে এখনই। আমাদের সংশ্লিষ্ট খাত সমূহ বাড়াতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা। এটি আপাত মনে হচ্ছে, আপনি তরুণদের ঠকিয়ে অন্য কোন খাতে এগিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু, বাস্তব বিবেচনায় আগামী দিনের জন্য যা সুখকর হবে বলে মনে হচ্ছে না। কেননা, দক্ষতা অর্জনের সময়ে যদি আমরা যদি আমরা যথাযথ বিনিয়োগ করতে না পারি তবে তার সুফলও পর্যাপ্ত পাওয়া যাবে না। একজন তরুণও যদি অদক্ষ হয় তার দায় রাষ্ট্রের।
এটা শুধুমাত্র বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ না আমাদের সম-উন্নয়নশীল দেশগুলোতে একই। সেক্ষেত্রে, বড় পার্থক্য করে দেবে দেশগুলোর আর্থিক সক্ষমতা, বিনিয়োগ ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন দক্ষতা। মনে রাখতে হবে, তরুণদের জন্য বিনিয়োগ কোন দয়া বা দান-দাক্ষিন্য নয় বরং এটি আমাদের সুরক্ষিত আগামীর একটি সুন্দর নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতি।
সেজন্য,বর্তমানের তরুণদের অনাগত দিনের সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উপযোগী করাই হবে শিশুদের জন্য বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। মোট কথা বদলে যাওয়া সামাজিক ও জনমিতিক কাঠামোর সুফল আমরা পাবো কিনা? তা নির্ভর করছে আমরা আমাদের তরুণদের জন্য কতটা বিনিয়োগ বর্তমানে করছি ও তা কতটা দক্ষতার সাথে বাস্তবায়ন করতে পারছি তার ওপর।