করোনা প্রিয় মানুষগুলোকে নিয়ে যাচ্ছে: ড. জাফর ইকবাল

ড. জাফর ইকবাল
ড. জাফর ইকবাল  © ফাইল ফটো

যখন আমাদের দেশে করোনা মহামারি শুরু হয়েছিল, তখন এই ভাইরাসকে একটি নির্বোধ ভাইরাস ছাড়া বেশি কিছু ভাবিনি। পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে আমাদের দেশে মৃত্যুর হার অনেক কম বলে মাঝে মাঝে খানিকটা সান্ত্বনাও পাওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে গভীর বেদনা নিয়ে আবিস্কার করছি এই ভাইরাসটি বেছে বেছে আমাদের প্রিয় মানুষগুলোকে নিয়ে যাচ্ছে। এ রকম সর্বশেষ মানুষ হচ্ছেন জিয়াউদ্দিন তারিক আলী, আমাদের 'তারিক ভাই'। যখন তার চলে যাওয়ার খবরটির সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটারের স্ট্ক্রিনে তার ছবিটি ভেসে উঠল, আমি একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। একবারও ভাবিনি তিনি এভাবে চলে যাবেন। খবরটি পড়েও বিশ্বাস হতে চায় না।

তারিক আলীকে আমি বহুদিন থেকে চিনি। সেই আশির দশকের শেষে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে নিউজার্সি এসে তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছিল। বাংলাদেশের জন্য সময়টি তখন খারাপ, যুক্তরাষ্ট্রের বাঙালিদের মাঝেও তার প্রভাব পড়েছে। এক দিন এক বাঙালি পরিবারের বাসায় একজন বিখ্যাত গায়কের অনুষ্ঠান শুনতে গেছি (তার নাম বললে সবাই তাকে চিনবেন) তিনি দেশাত্মবোধক গান গাইছেন, সেখানে বঙ্গবন্ধুর নাম আছে, গান গাওয়ার সময় গায়ক তার নামটি উচ্চারণ করলেন না। গান থামিয়ে কারণটা ব্যাখ্যাও করে দিলেন- বিতর্কিত একজন মানুষের নাম তিনি উচ্চারণ করতে চান না! গান শেষ হওয়ার পর আমি পকেট থেকে ১০ ডলার বের করে তার হারমোনিয়ামের ওপর রেখে বললাম, গান গেয়ে কিছু উপার্জন করার জন্য এই আয়োজন। সেই হিসেবে এটা আমার কন্ট্রিবিউশন, কিন্তু এখানে বসে আমার পক্ষে তার গান শোনা সম্ভব না। এত বিখ্যাত একজন গায়ককে আমি এভাবে অপমান করেছি সেই হিসেবে নিউজার্সিতে অনেকেই আমার ওপর খুব নাখোশ ছিল।

সেই পরিবেশে নিউজার্সিতে তারিক আলী ছিলেন আমাদের অনুপ্রেরণা। বাংলাদেশের যে কোনো বড় দিবসের আগে অনেক বড় অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করা হতো, পুরোটাই হতো তারিক আলীর ওপর ভরসা করে। কী কী গান গাওয়া হবে সেগুলো তিনি ঠিক করতেন। তারপর দিনের পর দিন রিহার্সাল করে শিল্পীদের সেই গান শেখাতেন। যুক্তরাষ্ট্রে বড় হয়েছে ছেলেমেয়েদের মুখে বাংলা আসতে চায় না ('ত' উচ্চারণ করতে পারে না। শুধু তাই নয়, সেটা শুনতেও পায় না, 'ট' হিসেবে শুনে।) আড়ষ্ট একটা উচ্চারণে তারা বাংলা বলে। তাদের বাংলা গান শেখানো সহজ কথা নয়। কিন্তু তারিক আলীর ধৈর্য অপরিসীম, তিনি একটির পর একটি গান শেখাতেন। মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় রিহার্সাল হতো, দোতলায় যেখানে রিহার্সাল হতো সেটা খোলামেলা, নিচ থেকে দেখা যেত, আমরা নিচ থেকে দেখতাম তিনি কী দরদ দিয়ে গান শেখাচ্ছেন।

আমি এখনও স্পষ্ট শুনতে পাই তারিক আলী 'তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি' গানটি শেখানোর সময়, 'ও বাঙালি ও ...' বলে একটা টান দিচ্ছেন, একটি গান যে কত দরদ দিয়ে গাওয়া যায়, সেটি আমি তাকে দেখে জেনেছিলাম। তিনি যে 'বাঙালি' বলার সময় পুরো দরদ ঢেলে দিতেন তার কারণ তিনি যে শুধু গানের লিরিকটি বলছেন তা নয়। তারিক আলী তার বিশ্বাসের কথা বলছেন, তার স্বপ্নের কথা বলছেন, তার ভালোবাসার কথা বলছেন। তিনি ছিলেন পুরোপুরি বাঙালি, তার চেয়ে বেশি বাঙালি হওয়া সম্ভব কিনা আমি জানি না।

প্রায় ঠিক এর কাছাকাছি সময়ে তারেক মাসুদ তার 'মুক্তির গান' ছবিটি নিয়ে কাজ করছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় লিয়ার লেভিন নামে একজন সাংবাদিক তার ক্যামেরা ক্রু নিয়ে বাংলাদেশের যুদ্ধক্ষেত্রে ফিল্ম করেছেন বলে শোনা যেত। কিন্তু সেই ফিল্ম কেউ কখনও দেখেনি। সেই খবর পেয়ে ক্যাথরিন এবং তারেক মাসুদ লিয়ার লেভিনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, তার নামটি ছাড়া তারা আর কিছুই জানে না। সেটিই সম্বল করে তারা টেলিফোন গাইড দেখে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যত লিয়ার লেভিনকে পাওয়া যায় তাদের সবাইকে ফোন করে যেত। এভাবে চেষ্টা করতে করতে এক দিন তারা আসল লিয়ার লেভিনকে পেয়ে গেল। কিন্তু তিনি ক্যাথরিন এবং তারেক মাসুদকে তার ফিল্ম দিতে রাজি নন, যে দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারে, তাদের তিনি আর বিশ্বাস করতে পারেন না। অনেক কষ্ট করে তাকে বুঝিয়ে সেই ফিল্ম উদ্ধার করা হলো, কিন্তু তিনি অনেক রকম বাধ্যবাধকতা দিয়ে দিলেন, সেগুলো অনেক খরচের ব্যাপার। খবর পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাঙালিরা সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলো এবং একদিন মুক্তির গানের প্রাথমিক ভার্সনটি নিউজার্সিতে আমাদের দেখানো হলো। আমরা দেখি আর চোখ মুছি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সেই অবিশ্বাস্য সময়টুকু একজন বিদেশি গভীর মমতায় তার ক্যামেরায় ধরে রেখেছে। সেখানে তারিক আলী- আমাদের সবার 'তারিক ভাই' আছেন। শুকনো পাতলা একটা ছেলে, চোখে ভারী চশমা। দেশের জন্য তার কী আবেগ, কী ভালোবাসা! তিনি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে চান কিন্তু চোখে এত ভারী চশমা তাই তাকে সুযোগ দেওয়া হয় না। তিনি তাই তার দলের সবাইকে নিয়ে গান গেয়ে গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছেন। সেই ছবিটি দেখলে এখনও আমরা বুকের ভেতর কাঁপুনি অনুভব করি। এত মানুষের এত ভালোবাসার একটি দেশ, সেই দেশের জন্য ভালোবাসার মর্যাদাটুকু না দিলে কেমন করে হবে?

তখন তারিক আলী একদিন নিজের দেশের মাটিতে ফিরে এলেন। তার কিছুদিন পর তারেক মাসুদ ক্যাথরিনকে নিয়ে দেশে এলো এবং প্রায় মোটামুটি একই সময়ে আমিও আমার পরিবার নিয়ে ফিরে এলাম।

যখন দেশের বাইরে ছিলাম তখন সুযোগ পেলেই নানা দেশের মিউজিয়াম দেখতে গিয়েছি। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে যতবার হলোকাস্ট মিউজিয়ামটি দেখেছি ততবার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিভীষিকার রূপটি দেখে হতবাক হয়েছি। সেগুলো দেখতাম আর ভাবতাম পাকিস্তানি মিলিটারি আর রাজাকার আলবদরদের হাতে আমাদের ১৯৭১-এর বিভীষিকা তো কোনোভাবেই এর থেকে কম নয়, তাহলে আমাদের দেশে কেন একটি মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর তৈরি হয় না? উত্তরটি অবশ্য আমি নিজেই জানি, ৭৫-এর হত্যাকাণ্ডের পর যে সরকারগুলো ক্ষমতায় এসেছে তাদের কারও মুক্তিযুদ্ধের জন্য কোনো মায়া নেই। সেই সরকারগুলো কখনোই জাদুঘর তৈরি করবে না, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর যদি তৈরি করতে হয় সেটা হতে হবে অনেকটা ব্যক্তিগত উদ্যোগে।

সত্যিই তাই হলো। ১৯৯৬ সালে সেগুনবাগিচার একটি ভাড়া বাসায় আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরটি প্রথমবার সবার জন্য উন্মুক্ত করা হলো। ডা. সারওয়ার আলীর ভাষায় ট্রাস্টি বোর্ডের মেম্বার সাত ভাই চম্পা এবং এক বোন পারুল! আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, সাত ভাই চম্পার একজন তারিক আলী- আমাদের তারিক ভাই। সুযোগ পেলেই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে নিজে গিয়েছি অন্যদের নিয়ে গিয়েছি। পেছনের চত্বরটিতে কতবার কত রকম অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি তার কোনো হিসাব নেই। যখন জাদুঘরটি আগারগাঁও তার স্থায়ী ভবনে স্থানান্তরিত হলো এর পেছনেও তারিক আলীর বিশাল অবদান। তারিক আলী কর্মজীবনে প্রকৌশলী, তাই তার সমস্ত মেধা তিনি মিউজিয়ামের জন্য ঢেলে দিয়েছেন। যতদিন মিউজিয়ামটি এই দেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সেই মহান দিনগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেবে, ততদিন তারিক আলীর স্মৃতি তার সঙ্গে জড়িত থাকবে।

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের জন্য তার মতো নিবেদিত মানুষ খুব বেশি নেই। মনে আছে ২০০০ সালের দিকে আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভবনের নামকরণ করেছিলাম। বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে জাহানারা ইমাম, সত্যেন বোস, জিসি দেব, হাছন রাজা এ রকম সব বরেণ্যজনের নাম ছিল। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি সঙ্গে সঙ্গে এই নামকরণের বিরুদ্ধে ভয়াবহ একটা তা ব শুরু করে দিল। এর প্রতিবাদে ২৫ ডিসেম্বর একটি সভা ডাকা হয়েছে এবং জামায়াত-শিবির সরাসরি ঘোষণা দিয়ে সেটি প্রতিহত করার হুমকি দিল। সারা শহরে ভয়াবহ উত্তেজনা, বোমা পড়ছে, গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, আগুন জ্বলছে; রীতিমতো যুদ্ধাবস্থা। যারা আয়োজক পরদিন সবাই নিরাপদে সভায় পৌঁছাতে পারবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই, তাই সবাই আগের রাতেই সুলতানা কামালের বাসায় রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমার ওপর জামায়াত-শিবিরের আক্রোশ সবচেয়ে বেশি, তাই আয়োজকরা আমাকে আসতে দিলেন না। যখন এই রকম ভয়াবহ অবস্থা, তার মাঝে তারিক আলী সভায় যোগ দেওয়ার জন্য রীতিমতো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খুব ভোরে ঢাকা থেকে সিলেট চলে এলেন! এ রকম একটি সময়ে তিনি চুপ করে ঘরে বসে থাকবেন কেমন করে?

২০১৩ সালে দেশে প্রশ্নফাঁসের বিশাল উৎসব! আমি নানাভাবে সেটার বিরুদ্ধে কথা বলে যাচ্ছি, কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না। এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আবিস্কার করেছি দেশের বড় বড় শিক্ষাবিদ অধ্যাপক কেউ মুখ ফুটে কিছু বলেন না। আমি কোনো উপায় না দেখে ঠিক করলাম, দরকার হলে একদিন একা প্ল্যাকার্ডে 'প্রশ্নফাঁস মানি না মানব না' লিখে শহীদ মিনারে বসে থাকব। সত্যি সত্যি একদিন বসে গেলাম, মোটামুটি একাই বসে ছিলাম, আমার খুব ঘনিষ্ঠ দু-একজন ছাড়া কেউ নেই, সঙ্গে শুধু কম বয়সী কিছু ছেলেমেয়ে আছে। তুমুল বৃষ্টি- এর মাঝে তারিক আলী এসে আমার পাশে বসে থাকলেন! তিনি কোথায় নেই?


এই দেশের যত অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন তার সবগুলোতে তিনি আছেন। বনানীতে যে শারদীয় পূজামণ্ডপ হয় তিনি এর একজন উদ্যোক্তা। 'বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও'-এর আহ্বায়ক হয়ে সারাদেশে ঘুরে ঘুরে নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়ন করার স্বপ্নে 'সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন'-এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তার কাজের কি শেষ আছে?

আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারি না এই মানুষটি আর আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসবেন না। বলবেন না, 'কী জাফর?

কেমন আছ?'

লেখক : মুহম্মদ জাফর ইকবাল, কথাসাহিত্যিক, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট


সর্বশেষ সংবাদ