সব পেয়েছি বাবা, শুধু ‘কুটি’ ডাকটাই শুনি না

প্রথম ছবিটা আমার বাবার। ১৯৮৬ সালে আমার জন্মের কিছুদিন পর তোলা। আর দ্বিতীয় ছবিটা আমার, এবছরই তোলা।
প্রথম ছবিটা আমার বাবার। ১৯৮৬ সালে আমার জন্মের কিছুদিন পর তোলা। আর দ্বিতীয় ছবিটা আমার, এবছরই তোলা।  © সংগৃহীত

‘কুটি’ হচ্ছে আমার আদরের ডাক নাম। এই নামে ছোটবেলায় আমাকে অনেকেই ডাকলেও বড় হওয়ার সাথে সাথে সবার কাছে আমি ‘মিলটন’ হয়ে গেছি। শুধু আমার বাবার কাছে আমি আজীবন ‘কুটি’ হয়েই ছিলাম। এক সময় কুটি বাবার হাত ধরে হাঁটত পরে বাবাও কুটির হাত ধরে হেঁটেছেন।

ছোটবেলা থেকেই আমার রাত জেগে পড়ার অভ্যাস। এই অভ্যাস হওয়ার একটা বড় কারণ ছিলেন আমার বাবা। বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার। তাই প্রায় রোজ রাতেই ডিউটি শেষে করে অনেক রাতে বাসায় ফিরতেন। আর সেই ছোটবেলা থেকেই আমি ভাবতাম বাবা রাত জেগে ডিউটি করবে আর আমরা সবাই ঘুমিয়ে থাকবো তা হবে না।

তাই যখন আমি ফাইভ বা সিক্সে পড়ি তখন থেকেই আমি চেষ্টা করতাম জেগে থাকতে। তাই যত রাতই হোক বাবা বাসার সামনে এসে প্রথমেই ‘কুটি’ বলে ডাক দিতেন। জেগে থাকলে আমি দরজা খুলে দিতাম। ঘরে ঢুকে বাবা ইউনিফর্ম চেঞ্জ করতেন আর আমি দেখতাম, অপেক্ষা করতাম। মূলত তখন থেকেই পুলিশের ইউনিফর্মের প্রতি আমার একটা ভালবাসা জন্মেছিল।

কোনো কোনো রাতে আমি ঘুমিয়ে পড়লে বাবা আমাকে ডেকে তুলতেন। এই ডেকে তোলার কারণ ছিল ‘দুধভাত’।আমার আর বাবার দুজনেরই প্রিয় খাবার ছিল দুধভাত। সারাদিন আমরা যা কিছুই খাই না কেন রাতে দুধভাত না খেলে আমাদের পেটের ভাত হজম হতো না। তাই ফ্রেশ হওয়ার পর বাবা অন্যান্য তরকারি দিয়ে খাওয়া শেষ করলে বাপ-বেটা একসাথে দুধভাত খেয়ে ঘুমাতে যেতাম।

আমি যখন ইনিভার্সিটিতে ভর্তির হলাম বাবা তখন রিটার্ড করে গ্রামের বাড়িতে থাকেন। তখনও আমি যখন বাড়িতে যেতাম আমরা একসাথে দুধভাত খেতাম। বাবা যতদিন সুস্থ ছিলেন ততদিন এটাই ছিল নিয়ম। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে এমনই সহজ ছিল ভালবাসার প্রকাশ।

বাবার ইউনিফর্ম দেখে দেখে ছোটবেলা থেকেই ইউনিফর্মের প্রতি আমার একটা ভালবাসা জন্ম নিয়েছিল। বাবাও আমাকে পুলিশ অফিসার হিসাবে দেখতে চাইতেন। কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির পর প্রথমে ছাত্র রাজনীতি পরে সাংবাদিকতার নেশায় আমি শৈশবের স্বপ্ন একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম।

বাবা অসুস্থ হওয়ার পর আমি বাবার কথায় আবার আমার শৈশবের স্বপ্ন আর বাবার ইচ্ছা পূর্ণ করার কথা মনে হলো। কিন্তু তখন আমি ভয় পেতে শুরু করেছি। পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছি, পাসপোর্টে জার্মানির ভিসাও লেগে গেছে, ফ্লাইটের আর এক মাস বাকি। আমি ভাবতাম আমাকে দিয়ে এই দেশে আর কিছু হবে না। তাই ঢাকার সব কাজ ক্লোজ করে বাবা-মায়ের সাথে কিছু সময় কাটানোর জন্য বাড়িতে গেলাম।

হুট করে একদিন সন্ধ্যায় বাবা আমাকে ডেকে কাছে বসতে বললেন। জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। তারপর বললেন, “কুটি, আমার শরীর খুব অসুস্থ লাগে। এই সময় তুই চলে গেলে আমি মরে যাবো। তোর এখন বিদেশে পড়তে যেতে হবে না। দেশেই চাকরির চেষ্টা কর।”

তারপর এক রকম যুদ্ধ করেই আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে হয়েছে। যাকে বলে, সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের দশ ফোঁড়। আমি বাবার স্বপ্ন পূর্ণ করতে পরেছি। শৈশবের ভালোবাসার ইউনিফর্ম এখন আমার হয়েছে কিন্তু বাবা দেখে যেতে পারেননি। আমি পুলিশের ইউনিফর্ম পড়ার পর আজ বাবার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। তাই সারাদিন খুব বাবার কথা মনে পড়ছে।

বারবার মনে হচ্ছে, পাঁচ বছর হলো আমাকে কেউ আর ‘কুটি’ বলে ডাকে না, আমরা বাপ-বেটা আর এক সাথে বসে দুধভাত খাই না। ২০১৪ সালের ৯ জুন বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। এখনও গভীর রাতে মাঝে মাঝে মনে হয় কেউ হয়ত ‘কুটি’বলে ডাকছে। কিন্তু না, ওই নামে আমাকে কেউ আর ডাকে না... কেউ কখনও আর ডাকবে না।

লেখক: এসিস্ট্যান্ট পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট, বাংলাদেশ পুলিশ।


সর্বশেষ সংবাদ