কেন আমরা বিসিএস ক্যাডার আসক্তিতে ভোগী?
করোনাকালীন সময়ে বারবার বাধাগ্রস্ত হয়ে প্রায় চার বছর পর দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে গত সপ্তাহে ৪০ তম বিসিএসের চূড়ান্ত সুপারিশের ফল প্রকাশিত হয়েছে। এতে বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশ পেয়েছেন ১৯৬৩ জন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। ক্যাডার চয়েজ ও সুপারিশ প্রাপ্তিতে বড় একটি রুচিগত পরিবর্তনও এবার লক্ষণীয় আগের তুলনায়।
গত এক দশকে আমাদের মেধাবী সমাজের পেশাগত রুচির ব্যাপক পরিবর্তন ধারাবাহিকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এবারেও সেই ধারাবাহিকতা লক্ষণীয়।
গত এক দশক থেকে চাকুরী প্রার্থীদের রুচি সংক্রান্ত একটি জরিপ করলে দেখা যাবে তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীদের রুচি ও চাহিদার একমাত্র জায়গা যেন এক জায়গাতে আবদ্ধ। আর তা হল বিসিএস ক্যাডার হওয়া। আরও স্পষ্টভাবে বললে কথিত প্রথম সারির ক্যাডার হওয়া। যেমন- পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ, ট্যাক্স ইত্যাদি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন পড়াশোনার গ্রুপগুলোতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুও এটাই। জাতির জন্য উদ্বেগ ও আশঙ্কার বিষয় হল, এসব গ্রুপে স্কুল/কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও পরামর্শ চেয়ে পোস্ট দেন, কীভাবে এখন থেকেই তারা বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারে। একই প্রভাব লক্ষ করা যায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্লাসেও। বিসিএস প্রস্তুতির বই নিয়ে শিক্ষার্থীরা ডুবে থাকেন অগ্রিম প্রস্তুতির অংশ হিসেবে। তারা যতটা না তার পঠিত বিষয়ের টেক্সটবুক পড়তে আগ্রহী, তার থেকেও বেশি আগ্রহী বাজারের নানা রঙের মোড়কে বিসিএস প্রস্তুতির গাইড বইগুলো পড়তে।
আরও পড়ুন : ফ্রিতে হলেও টিউশন পড়ানো উচিত
সামাজিকভাবে মেধার মানদণ্ডও আজকাল হয়ে উঠেছে বিসিএস ক্যাডার হওয়া না হওয়ার ভিত্তিতে। এখন শিক্ষার্থীরা যে বিষয়েই উচ্চতর পড়াশোনা করুক না কেন, তাদের মাঝে ভালো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, গবেষক, বিজ্ঞানী বা সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছের কথা খুব একটা শোনা যায় না। সব দিক ভুলে গিয়ে অনেক শিক্ষার্থীর একটাই চাওয়া, তারা প্রথম সারির নির্দিষ্ট কিছু ক্যাডার হবেন।
কেউ যদি এই ক্যাডারগুলো প্রথম ধাপে না পেয়ে অন্যান্য ক্যাডার বা তার পেশাগত (টেকনিক্যাল) ক্যাডার পান তাহলে পরবর্তী বিসিএসের মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে তার মেধা অনুযায়ী এ ক্যাডারগুলোতে চলে আসেন দুই তিন বছর চাকরি করার পরে। অথচ সরকার সব ক্যাডারকেই নবম গ্রেডে একই বেতন কাঠামোতে নিয়োগ দিয়ে থাকেন।
বিসিএসের বাইরেও ব্যাংকসহ যেসব চাকরি নবম গ্রেডে আছে সেগুলো থেকেও চাকরি পরিবর্তন করে এসব চাকরিতে আসা বর্তমান নিয়োগের ক্ষেত্রে খুব সাধারণ ঘটনা। এমনকি এককালে চাকরি রুচির প্রথম সারির ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সামাজিকভাবে অভিজাত পেশা ছেড়ে আসাও আজকাল সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চাকরির স্থিতিশীলতা ও নিশ্চয়তার চিন্তা করলে বেসরকারি সংস্থায় বেশি বেতনের চাকরি ছেড়েও সরকারি চাকরিতে আসার প্রবণতা সাধারণভাবেই নেওয়া যায় কিন্তু সরকারি এবং সামাজিক মর্যাদা, মানব ও সমাজসেবার সুযোগ এবং একই বেতন কাঠামো থাকা সত্ত্বেও আমাদের এই মেধাবী সমাজের রুচির পরিবর্তন কি শুধুই স্বপ্ন নাকি ‘আসক্তি’?
পৃথিবীর বেশিরভাগ উন্নত দেশগুলোতে বিসিএস ক্যাডার সমপর্যায়ের চাকরির জন্য এতটা স্বপ্ন বা আসক্তি মানুষের মাঝে খুব বেশি লক্ষ করা যায় না, যা আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশ আরও স্পষ্ট করে বললে বাংলাদেশের মতো দেশে বেশি দেখা যায়।
আরও পড়ুন : স্বামী প্রশাসনে ৭ম, স্ত্রী পুলিশ ক্যাডার
সম্ভবত এটা হওয়ার বড় কারণ এখানে ক্ষমতা ও সুযোগ সুবিধার চর্চা বেশি হয়। এখানে সবকিছুর ঊর্ধ্বে হল ক্ষমতার চর্চা। কেউ যখন তার কাছের কাউকে এ ক্ষমতা চর্চা করতে দেখেন অথবা নিজে ক্ষমতার অপব্যবহারের ভুক্তভোগী হন তখন তার মধ্যেও তা অর্জনের আসক্তি জেগে ওঠে অথবা নিজের সন্তানের মধ্য দিয়ে তা অর্জন করতে সন্তানের ওপর তাদের ইচ্ছাশক্তি চাপিয়ে দেন।
সম্প্রতি এমন উদাহরণ এ দেশেই সৃষ্টি হয়েছে বহুবার। সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চাইলেও মা-বাবা বা আত্মীয়দের চাপ থাকে তাকে পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেট হতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে তারাও এ বাস্তবতা মেনে নেন। এজন্য অন্যান্য পেশায় সমান সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এই গুটিকয়েক ক্যাডারেই ‘আসক্তি’।
‘আসক্তি’ বলার কারণ হল, কোনও ছেলের স্বপ্ন ছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন এবং হয়তো তার স্বপ্ন পূরণও হয়েছে কিন্তু কিছু দিন পর লক্ষ করলেন তার ক্ষমতার চেয়েও একজন পুলিশ কর্মকর্তার বেশি ক্ষমতা। একইভাবে একজন ডাক্তার মানবসেবার স্বপ্ন নিয়ে তুমুল প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হয়ে ডাক্তারি পাস করে বিসিএসে প্রথম পছন্দ দিয়ে থাকেন পররাষ্ট্র, পুলিশ বা প্রশাসন। একই অবস্থা ইঞ্জিনিয়ার পাস করা মেধাবী শিক্ষার্থীও করেন।
যখন তারা ভর্তি হন তখন তাদের স্বপ্ন ছিল তিনি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবেন, কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি বুঝতে পারেন একজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার একজন প্রশাসন ক্যাডারের আওতায় চাকরি করতে হয়। সারা জীবন ক্লাসে ফার্স্ট সেকেন্ড হয়ে তুলনামূলক ভালো রেজাল্ট করে বুয়েট, মেডিক্যালে ভর্তি হলেও তার থেকে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী যারা সেখানে ভর্তির সুযোগ পাননি তারাই পুলিশ বা প্রশাসন ক্যাডারে থেকে তার ওপর ক্ষমতার চর্চা করেন।
দেশের পলিসি নির্ধারণ ও ভবিষ্যতে বড় ধরনের সাচিবিক দায়িত্বও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্তরা হয়ে থাকেন। একই বেতন কাঠামো এবং পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত প্রার্থীরা যখন দিন দিন এ ধরনের বৈষম্যের শিকার হন তখন তারা ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করতে তাদের লালিত স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে এসব ক্যাডারে আসতে ‘আসক্ত’ হয়ে পড়েন।
আরও পড়ুন : তাক লাগিয়ে কনস্টেবল থেকে পুলিশ ক্যাডার হলেন হাকিম
একজন ডাক্তার যখন ভাইভা বোর্ডে একটি কমন প্রশ্নের উত্তর দেন যে, আমি জনগণের সেবা করতে প্রথম পছন্দ প্রশাসন ক্যাডার দিয়েছি তখন একজন অল্প শিক্ষিত লোকও বুঝবেন উত্তরটা কতটা হাস্যকর, যা চিকিৎসা সেবার মতো মহৎ সেবাকে পিছে ফেলতে পারে।
একই চিত্র শিক্ষাসহ অন্যান্য ক্যাডারে। যারা এত যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে লাখ লাখ শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে ভাইভা বোর্ডে উত্তীর্ণ হন তাদের ক্যাডার ভেদে সম্মিলিত মেধা স্কোরে পার্থক্য খুব বেশি নয়; বরং বলতে গেলে প্রায় সমান। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে কথিত প্রথম সারির ক্যাডারগুলো অন্য ক্যাডারদের 'রাজা-প্রজা' শ্রেণিতে বিন্যাস করতে সচেষ্ট থাকেন।
ফলে এই কথিত দ্বিতীয় সারির ক্যাডাররা দুই বছর লস করেও একই বেতনের চাকরি ছেড়ে পরের বিসিএসে এই ক্যাডারে চলে আসেন বা আসার চেষ্টা করেন। এসব আন্তক্যাডার বৈষম্যের কারণে তারা একদিকে যেমন হীনমন্যতায় ভোগেন অন্যদিকে তার আসক্তি চরম পর্যায়ে চলে গেলে তার নিয়োগপ্রাপ্ত চাকরিতে দেশের কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতেও ব্যর্থ হন।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, তখন তাদের স্বপ্নের থেকে বেশি শক্তিশালী কাঠামো হিসেবে কাজ করে তাদের এই আসক্তি। আর আসক্তির ফলাফল আমরা সবাই জানি। আর এই ফলাফল সাধারণভাবেই জনগণ বেশি ভোগ করে থাকেন। কারণ, তাদের সেবার নিমিত্তেই এই আসক্তদের সরকার নিয়োগ দিয়ে থাকেন আর আসক্ত কর্মচারী থেকে আশানুরূপ সেবা পাওয়া অসম্ভব।
একসময় প্রশাসন ক্যাডার ছেড়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অথবা সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন এমন উদাহরণ এক দশক আগে থাকলেও এখন এমন ভাবাটা পাগলের প্রলাপ মনে হবে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা নেই, বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার নেই, প্রকৌশলী বা ডাক্তারদের তেমন কোনও বড় অর্জনও এখন আমাদের চোখে পড়ছে না।
যদিও কিছু স্বপ্নবাজ মেধাবী ভালো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক বা শিক্ষক হিসেবে তার ক্যারিয়ারকে বেছে নেয় তাহলে তাদের নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয় পদে পদে ক্ষমতাচর্চার বলি হয়ে। ফলে গবেষণা বা সৃজনশীল সুন্দরের চর্চাও গতিহীন হয়ে আসক্তির কাছে পরাজিত হয়।
আরও পড়ুন : বুয়েট-কুয়েট থেকে বিসিএসে প্রথম: শ্রম, সময় ও রিসোর্সের অপচয়
আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো চাইলেও সবাইকে চাকরি দিতে পারে না, অথচ একশ্রেণির মেধাবী শুধু ‘আসক্তি’র কারণে চাকরি পরিবর্তন করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বিসিএস ক্যাডার তথাকথিত প্রথম সারির ক্যাডার নিয়ে যতটা তৎপর ততটা প্রচারণা কোনও বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক বা সৃজনশীল গবেষকদের নিয়ে করে না। ফলে সমাজের মেধার ও সম্মানজনক চাকরির একমাত্র মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে বিসিএস ক্যাডার বা কথিত প্রথম সারির ক্যাডার।
বিয়ে থেকে প্রেম-এখন এমন অনেক সম্পর্কও এই মানদণ্ডতে মাপা হয়। সেখানে থাকে না সততা-নিষ্ঠা কিংবা সুখ শান্তির বিচার। এসব সামাজিক বাস্তবতা যেকোনো দেশের ক্ষতির কারণ হয়। তাই আমাদের সময় এসেছে আন্তক্যাডার বৈষম্য রোধ, অন্যান্য চাকরিতে যথাসম্ভব সম-সুবিধা নিশ্চিতসহ দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করে চাকরির ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা বজায় রেখে সাধারণ মানুষের নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা। দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবেসে আমরা আবারও আমাদের স্বপ্ন দেখতে চাই, ‘আসক্ত’ হতে চাই না। আর এজন্য প্রচলিত ক্ষমতা কাঠামোর সংস্কার ও অন্য সব চাকরিজীবীর মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে সংশ্লিষ্টদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: নাট্যকার ও কলামিস্ট।