২০ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:১৯

শাবি শিক্ষকদের হীনমন্যতা

মারুফ মল্লিক  © সংগৃহীত

৭৩ এর অধ্যাদেশের বাইরে মানে গত শতকের ৯০ এ গড়ে উঠা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একধরনের হীনমন্যতা আছে। এরা ঢাবি, চবি, রাবি ও জাবির সমকক্ষ হতে চায়। কিন্তু বয়সের কারণে হতে পারে না। এই হীনমন্যতা আবার শাবির মধ্যে প্রকট। হীনমন্যতা তাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্যেও দেখা যায়।

ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি না খুলে এরা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো শুরু করে। যেমন শুরুর দিকে শাহজালালে পলিমার কেমিস্টি অ্যান্ড টেকনোলজি বা এরকম বিষয়ে ব্যাচেলর পড়ানো হতো। আমরা মনে করতাম এ না জানি কোন মহান সাবজেক্ট। পরে এখন দেখি ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি খুলে কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো হচ্ছে। এবার শিক্ষার্থীরা পড়লেন বিপাকে। পড়েন ইঞ্জিনিয়ারিং। কিন্তু নিজেদের ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে পরিচয় দিতে পারে না। এমনকি ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে চাকুরিও পায় না। পরে মনে হয় এই বিভাগের নাম পরিবতন করে পলিমার অ্যান্ড কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং রাখা হইছে।

আরও পড়ুন: আন্দোলনকারীদের অনশন ভাঙাতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলেন শাবিপ্রবি শিক্ষকেরা

মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং না খুলে প্রডাকশন টেকনোলজি বা সাইন্স বা এরকম নামে শুরু হলো। চাইলেই কিন্তু তারা ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি খুলে প্রকৌশল বিজ্ঞান পড়ানো শুরু করতে পারতেন। এটা তেমন জটিল কোন বিষয় ছিল না। কিন্তু তারা চালাকি করলেন। দেখাতে চাইলেন অন্যদের থেকে পৃথক ও আধুনিক বিষয় আমরা পড়াচ্ছি। এরকম আচরণ উত্তর আমেরিকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো করেন। কারণ তাদের ওখানে টাকা দিয়ে পড়তে হয়। চটকদার বিষয় ও নাম না রাখলে শিক্ষার্থীরা আকৃষ্ট হবে না। তাই ওরা বিভিন্ন নামে একই বিষয় পড়ায়। কিন্তু শাবির শিক্ষকরা কেন ওই পথে হাটলের তা বোধগম্য না।

এই রকম চালাকি শাবির শিক্ষকরা সারাজীবনই করেন। যেমন একবার আন্তবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগীতায় মেয়েদের নাম দিয়ে ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন। সেবার অনুষ্ঠানটি জাবিতে হয়েছিল। এক পত্রিকার জাবি প্রতিনিধি নিউজ করে দিলেন শাবির পুরুষ রূপী নারী অথবা নারী রূপী পুরুষ প্রতিযোগী। সম্ভবত মাইকে নাম ঘোষণা করা হয়েছিল এক ছাত্রীর। আর মঞ্চে উঠে জোর করেই গাইতে শুরু করে এক ছেলে। জাবির শিক্ষকরা যতই তাকে থামাতে যান শাবির শিক্ষকরা জোর করেই তাকে গাইতে বলেন। এ নিয়ে হল্লাও হয় প্রচুর। মূল ঘটনা ছিল প্রথম শাবি এক ছাত্রীর নাম দিয়েছিল। পরে পরিবর্তন করতে চাইলেও সময় শেষ হওয়ায় সেই সুযোগ ছিল না। কিন্তু তারা গো ধরে থাকে তাদের সুযোগ দিতে হবে। অধ্যাপক সেলিম আল দীনের নেতৃত্বে আয়োজক কমিটি রাজী হয়নি এতে।

আরও পড়ুন: ‘চাষাভুষার সন্তান, আমরা সবাই সাস্টিয়ান’

যাই হোক সংবাদ প্রকাশের পর শাবিতে ওই পত্রিকার কপি পুড়ানো হয়। আর হুংকার দিয়ে মাঠে নামেন বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. জাফর ইকবাল। তিনি ঘোষণা দেন ওই প্রতিনিধিকে চাকুরিচ্যুত করা না হলে তিনি আর ওই পত্রিকায় কলাম লিখবেন না। তার এই গো ধরার কারণে বেচারা প্রতিনিধির চাকুরি শেষ পর্যন্ত আর টিকেনি। অথচ তিনি কোনো ভুল নিউজ করেননি। বরং বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল নিজের ক্ষমতা দেখালেন। এবং ভুল করলেন। মনে হয় এই ভুলটি তিনি ইচ্ছা করেই করেছিলেন। আমি যদি কখনো ড. জাফর ইকবালের সঙ্গে কথা বলতে পারি তবে জিজ্ঞাসা করবো এর জন্য তিনি অনুতপ্ত বা লজ্জাবোধ করেন কিনা। আমি নিজে ওই ঘটনার স্বাক্ষী। দুপুরে ভাল ঘুম দেওয়ার কারণে আমরা অন্যান্য প্রতিনিধিরা এই নিউজটি করিনি। আমরা হালকা ভাবেই নিয়েছিলাম।

বিজ্ঞানী জাফর ইকবালের এহেন যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কারণ হিসাবে আমরা যেটা জানতে পারলাম, তিনি নাসার চাকুরি ছেড়ে দেশে ফিরে জাবিতে স্ত্রী সমেত যোগদান করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাধসাধে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ। তারা মনে করেছিল, জাফর ইকবালের স্ত্রী ড. ইয়াসমিন হকের জাবিতে যোগ দেওয়ার যথেষ্ঠ যোগ্যতা ছিল না। আর ৯০ দশকের শুরুতে জাবির শুধু পদার্থই না কমবেশি সব বিভাগেই জাদরেল সব ফ্যাকাল্টি মেম্বাররা ছিলেন। এর বেশিরভাগই আবার বৃটিশ ডিগ্রিধারী। তাদের কাছে ড. ইয়াসমিনের উত্তর আমেরিকার ডিগ্রি, প্রকাশনা ও যোগ্যতা যথেষ্ট মনে হয়নি। আর ড. জাফর ইকবালকে কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগ নিতে নিমরাজি ছিল। আরেকটি কথা শোনা যায়, আমাদের জাবির নাট্যাচার্য মহোদয়ও এর বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি সাংস্কৃতিক অভিভাবকত্বের ভাগ অন্য কাউকে দিতে চাননি। তাই স্ত্রী বিরহে কাতর ড. জাফর ইকবাল নতুন প্রতিষ্ঠিত শাহজালাল পানে রওনা দিলেন।

আরও পড়ুন: মুরগি আগে না ডিম? যুগ যুগ ধরে চলা রহস্যের সমাধান গবেষণায়

আমরা ধরে নিতে পারি ওই প্রতিনিধির বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনয়নকারী ড. জাফর ইকবাল এক ধরনের হীনমন্যতা থেকেই এটা করেছিলেন। সেই থেকে জাবির সঙ্গে শাবির দ্বন্দের শুরু করে। আবার এই দ্বন্দের পিছনে জাবির কিছু সাবেক শিক্ষার্থী যারা শাবিতে যোগ দিয়েছেন তারাও কিছুটা জড়িত বলে শোনা যায়। কারণ তারাও বিজ্ঞানী জাফর ইকবালের মত মনে করেন জাবিতে তাদের যোগ দিতে দেওয়া হয়নি। এ থেকেই শাবিতে কালেক্টিভলি জাবি নিয়ে হীনমন্যতাজনিত ঈর্ষার সৃষ্টি হয়েছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হল্লা করায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাবির নৃবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস করা শাবির এক শিক্ষক। ওই শিক্ষক অধ্যাপক আফসার আহমেদসহ অন্যান্যদের সঙ্গে রীতিমত ঝগড়া শুরু করে দিয়েছিলেন। এই ঝগড়া অনেকদিন বজায় ছিল।

ঝগড়াকে আবার উস্কে দিলেন শাবির ভিসি অহেতুক এক মন্তব্য করে। এ থেকে বুঝা গেল জাবি নিয়ে তারা কি ধরনের মানসিকতা পোষণ করেন। বিজ্ঞানী জাফর ইকবাল থেকে অর্থনীতিবিদ ফরিদউদ্দিন সবই এক কাতারের। জাবি দেখলেই ঝাপিয়ে পড়েন। জাবি নিয়ে শাবির শিক্ষকদের বালখিল্য আচরণ ও মন্তব্য হীনমনত্যা আর কিছুই না। এ থেকে তারা বেরিয়ে আসতে না পারলে শাবি আসলে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনোই পরিণত হতে পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয় মানে কেবল সার্টিফিকেট প্রদান করা না। কিন্তু দু:খ জনক হলেও সত্য শাবির শিক্ষকরা ইনফরমাল প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের মত আচরণ করছেন। এসব করতেই থাকলে বরং কওমি মাদ্রাসাগুলো শাবি থেকে এগিয়ে যাবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক