গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় কার লাভ হলো

ভর্তি পরীক্ষার্থী
ভর্তি পরীক্ষার্থী  © সংগৃহীত

জগতে সবই লাভের কারবার। রোমান্টিকদের তেমন আহ্লাদিত হওয়ার কিছু নেই। এখানে আর্থিক লাভের কথা বলা হচ্ছে। তা বেঁচে থাকতে, প্রয়োজনগুলো মেটাতে অর্থকড়ির দরকার যেহেতু আছে, সেহেতু আর্থিক লাভ তেমন খারাপ কিছু নয়। এটা জরুরিও। কিন্তু এটা যদি কারও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে করা হয়, তখনই সমস্যা। কথাটা এল দেশে প্রথমবারের মতো হওয়া গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা এবং তার পরবর্তী ঘটনাবলির কারণে। এখানে বিপুলসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীকে রীতিমতো নাকাল করে ছাড়া হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার একটি মৌসুম আছে বাংলাদেশে। এই মৌসুম শুরু হয় এইচএসসি পরীক্ষার ফল ঘোষণার পর থেকে। সে সময় সদ্য এইচএসসি পাস করা তরুণ-তরুণীদের পায়ের তলায় শর্ষে এসে জমা হয়। তাই তাদের গোটা দেশের এ প্রান্ত-ও প্রান্ত ছুটে বেড়াতে হয়। তা-ও আবার এই বয়সীদের খুবই অপছন্দের একটি কাজ করার জন্য এই ছোটাছুটি—তা হলো পরীক্ষা। যেচে বিভিন্ন জেলায় গিয়ে পরীক্ষায় বসতে হয় শিক্ষার্থীদের। আবার যেহেতু এই বিশেষ পরীক্ষা উৎসব একটি নির্দিষ্ট সময়েই হয়, সেহেতু তাদের ছুটতে হয় অনেকটা যন্ত্রের মতো। এই বাস ধরো, তো ফিরে এসে আবার লঞ্চে চড়ো। একটা ভালো হয় যে, ভূগোল বই পড়ে পড়ে যে দেশটাকে চেনা যায়নি এত দিন, সে দেশের আনাচকানাচ চেনা হয়ে যায়। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা জমে ঝুলিতে। কিন্তু সঙ্গে থাকা পথের কষ্ট, খাওয়ার কষ্ট, আর পরীক্ষার কষ্টটা তো আছেই। আর এই সব কষ্টকে ছাপিয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের জন্য যা বড় হয়ে দেখা দেয় তা হলো, অর্থকষ্ট।

এই সব কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে বহুদিন ধরেই গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার কথা আলোচনা হচ্ছিল। এবার প্রথমবারের মতো এই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশের ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় একযোগে ভর্তি পরীক্ষা নিয়েছে। লক্ষ্য ছিল, শিক্ষার্থীদের এভাবে সারা দেশ ছুটে বেড়ানোর বাস্তবতা থেকে মুক্তি দেওয়া। একই সঙ্গে এতগুলো ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক যে কষ্ট হয়, তা থেকে মুক্তি দেওয়া। এই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি খুশি সম্ভবত হয়েছিল শিক্ষার্থীদের পরিবারগুলো। সন্তানের পরীক্ষার জন্য তাদের অনেককেও তো এ সময়ে ছুটে বেড়াতে হয়। একই সঙ্গে যুক্ত থাকে নিরাপত্তার প্রসঙ্গটি। এই সময়ে এত এত ছোটাছুটির কারণে পথের অবস্থাও থাকে সঙিন। ফলে কষ্টটা বহুগুণে বেড়ে যায়। জলের মতো টাকা বেরিয়ে যায় পকেট থেকে। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর খুশি না হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। মনে মনে নিশ্চয় তারা ধন্যবাদ দিয়েছে এমন মহতী উদ্যোগ গ্রহীতাদের।

কিন্তু বাংলাদেশ এমনই দেশ, যেখানে কোনো এক পক্ষের প্রতি অন্য পক্ষের কৃতজ্ঞতাবোধ বেশি দিন স্থায়ী হওয়ার নয়। অধিকাংশ সময়ই দেখা যায়, একটু প্রাপ্তিযোগ হলো বলে আপনি গদগদ হয়ে দাতার গুণকীর্তন করতে বসেছেন যখন, তখনই দাতার নিজের প্রাপ্তির বিষয়টি সামনে এল। আর সেটা এমন মাত্রায় যে, তখন দাতার সেই উদারতাকেই মনে হবে কৌশলী বিনিয়োগ। এ ক্ষেত্রেও তেমনটি হয়েছে। প্রথমেই শিক্ষার্থীরা নাকাল হলো, সারা দেশে ছুটে বেড়ানোর বাস্তবতা থেকে মুক্তি না ঘটার কারণে। দেখা গেল শিক্ষার্থীর অবস্থান ঢাকায়, রেজিস্ট্রেশনও ঢাকায়, নিজ জেলা বরিশাল, অথচ গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার আসন পড়েছে ময়মনসিংহে। এমন কারণে বহু শিক্ষার্থীকে ঠিকই নানা জেলায় ছুটতে হয়েছে ভর্তি পরীক্ষা দিতে। প্রথমবার হওয়ায় এ ধরনের নানা বিপত্তি ছিল, যা ভবিষ্যতে হয়তো সামলে ওঠা যাবে।

কিন্তু তখনই প্রশ্ন ওঠে, যখন এই গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার পর নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের রীতিমতো অর্থকরী প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। নানা অজুহাতে নানা ধরনের ফি আরোপের কথা শোনা যাচ্ছে। আবার নিয়ম জারির ক্ষেত্রেও যখন যা, তখন তা—ধারা অনুসরণ করা হচ্ছে। ধরা যাক কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই। গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা যে ২০ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েছিল, তাদের একটি এটি। ১৬ নভেম্বর তারা ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) ও বিবিএ প্রথম বর্ষের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এই ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফলকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের ফলাফলের ওপর ১০০ নম্বর এবং গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার ওপর ১০০ নম্বর ধরে মোট ২০০ নম্বরের মধ্যে মেধাতালিকা তৈরি করা হবে।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে—এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে ১৬ নভেম্বর। আর গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার সর্বশেষ সি ইউনিটের ফল প্রকাশ করা হয়েছে ৩ নভেম্বর। এটা খুবই অদ্ভুত ব্যাপার যে, শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার মানদণ্ডটি না জেনেই পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়েছে। আবার এই যে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষার ফলাফলকে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে, সেই পরীক্ষাও কিন্তু গত বছর হয়নি করোনার কারণে। অর্থাৎ, অটোপাসের ফলাফলকেই বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। এ তো গেল কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। এভাবে প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের মতো করে নিয়ম ঘোষণা করছে। বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ভর্তি ফিসহ নানা ধরনের ফি। অনুষদ ধরে ভর্তি ফরমের বদলে বিভাগওয়ারি ভর্তি ফরম বিক্রি করা হচ্ছে।

বিষয়টি অনেকটা সুচতুর ব্যবসার মতো করেই হলো। শিক্ষার্থীরা এখানে ভোক্তা বা গ্রাহক ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের প্রথমে বিশেষ একটি সুবিধার কথা বলে আকৃষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু সেই সুবিধা যে আগুন, আর তারা যে আগুনপোকা, তা তারা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। এখন তাদের আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার পালা। বাধ্য হয়ে অনেকে এখন আগুনেই ঝাঁপ দিচ্ছেন। এটি অনেকটা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের মতো বিষয় হয়ে দাঁড়াল, যেখানে বিশেষ বিশেষ সুবিধার কথা বড় অক্ষরে লেখা থাকে, আর নিচে আণুবীক্ষণিক অক্ষরে লেখা থাকে ‘শর্ত প্রযোজ্য’। আকর্ষণের পালা ফুরালে ভোক্তাকে নিজের জালে আটকে ফেলতে পারলে এই শর্ত প্রযোজ্য অংশটিই বড় এবং একমাত্র হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রেও তেমনটি হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তো ভেবেছিল তারা সরকারি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে জ্ঞান আহরণ করতে চাইছে। তাঁরা বুঝতে পারেননি, তাঁরাও ভোক্তা। তাঁরা ভেবেছিল, তাঁদের কথা চিন্তা করে শ্রদ্ধেয় শিক্ষকেরা একটা বড় উদ্যোগ নিয়েছেন, নিজেদের মাথায় অনেক বড় বোঝা নিয়ে তাঁদের ও তাঁদের পরিবারের ঘাড় থেকে শারীরিক, আর্থিক ও মানসিক কষ্টের বোঝাটি নামাতে চেয়েছেন। কিন্তু আদতে এখন তাঁরা দেখছে—সবই গরল ভেল। সত্যটা উল্টো। এ এক আলোর ফাঁদ, যেখানে তাঁরা এখন আটকা পড়েছেন।

শারীরিক কষ্টটি প্রক্রিয়ার শুরুর ধাপেই তারা বুঝতে পেরেছেন, যা প্রথম পদক্ষেপ বিবেচনায় তাঁরা ক্ষমাও করে দিয়েছেন। কিন্তু আর্থিক কষ্ট লাঘবের যে বুলি, তা আদতে ফাঁকা কথা। এটা আসলে সুনির্দিষ্ট কাস্টমার ধরে পকেট কাটার ফন্দি। এখন অনুষদের বদলে বিভাগ ধরে আবেদন ফি আদায় করা হচ্ছে। এ অবস্থায় নিজেদের ট্যাকের দিকে একবার, আরেকবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং ‘গুচ্ছ’ ধারণার দিকে সবিস্ময়ে তাকানো ছাড়া শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকদের আর কোনো উপায় নেই। শেষ অঙ্কে এসে তাঁরা এখন প্রশ্ন ছুড়ছেন—গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় কার লাভ হলো? উত্তরের ঘরে নিজেদের নামটি তাঁরা লিখতে পারছেন না। অথচ তা-ই লেখার কথা ছিল। (আজকের পত্রিকা থেকে)

লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা


সর্বশেষ সংবাদ