এখতিয়ার বহির্ভূত পর্যবেক্ষণ প্রশ্নবিদ্ধ অপসারন !
ঘটনা ১ : গত ১১ নভেম্বর রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের মামলার রায় ঘোষণার পর পর্যবেক্ষণে আদালত পুলিশের উদ্দেশে এ পরামর্শ দেন। ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ৭-এর বিচারক বেগম মোসা. কামরুন্নাহারের আদালত আলোচিত এ মামলার রায় দেন। আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় বিচারক তাদের খালাস দেন।
ঘটনা ২ : আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণ মামলা নেওয়া যাবে না’ এমন পর্যবেক্ষণ সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক। এমন পর্যবেক্ষণ দেওয়ায় বিচারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আগামীকাল রবিবার প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দেওয়া হবে।
ঘটনা ৩: ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টা পর মামলা না নেওয়া সংক্রান্ত বিচারিক আদালতের পর্যবেক্ষণের জেরে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ৭-এর বিচারক বেগম মোসা. কামরুন্নাহারের বিচারিক ক্ষমতা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এই বিচারককে আর আদালতে না বসার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি।
উপরের তিনটি ঘটনার ক্রম খালি চোখে দেখলে বোঝা যাবে, কিভাবে একটি অপছন্দনীয় রায়ের পর একজন রায় দেয়া বিচারককে অপসারন করা হল। অথচ আমরা জানি বিচার বিভাগ স্বাধীন।
এবার দেখা যাক বিচারক রায়ে কি বলেছেন, ১১ নভেম্বর দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের মামলার রায় ঘোষণার পর পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেছেন, ‘ধর্ষণের ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পর পুলিশ যেন মামলা না নেয়। কারণ, ৭২ ঘণ্টা পর মেডিকেল টেস্ট করা হলে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না। তাতে মামলা প্রমাণ করা দুরূহ হয়ে পড়ে। এখানে বিচারকের শেষ কথাটির সঙ্গে আমি একমত। ৭২ ঘণ্টা পর মেডিকেল টেস্ট করা হলে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না। তাতে মামলা প্রমাণ করা আসলেই দুরূহ হয়ে পড়ে। কিন্তু এই দুরূহ কাজটি সফলভাবে সম্পন্ন করাই তদন্ত কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা, আইনজীবী এবং বিচার কাজে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দায়িত্ব। সুতরাং ‘ধর্ষণের ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পর পুলিশ যেন মামলা না নেয়,’ বিচারকের এই বক্তব্যটি অগ্রহণযোগ্য।
বিচারক বলেছেন, ‘সেদিন ধর্ষণের কোনো ঘটনা ঘটেনি। হোটেলে তারা অভিযুক্তদের সঙ্গে স্বেচ্ছায় শয্যাসঙ্গী হন। সেখানে তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হলেও জোরপূর্বক ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।’
তারমানে ৭২ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ায় ডিএনএ পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত না পাওয়া সত্ত্বেও ভিকটিম এবং অভিযুক্তদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হওয়ার বিষয়টি আদালতের সামনে প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ ডিএনএ টেস্ট ছাড়াই এধরনের অপরাধ আদালতে প্রমাণ করা সম্ভব। সুতরাং বিচারকের নিজের বক্তব্য অনুযায়ী তার ‘৭২ ঘণ্টা পর পুলিশ যেন মামলা না নেয়’ মর্মে যে নির্দেশনা তা অগ্রহণযোগ্য এবং এখতিয়ার বহির্ভূত।
বিচারক বলেছেন, ‘আগে থেকেই ভিকটিমরা ফিজিক্যাল রিলেশনে অভ্যস্ত ছিল। তারা তাদের বয়ফ্রেন্ডদের সঙ্গে ফিজিক্যাল রিলেশনে যান,’ –জজের এই বক্তব্যটি মারাত্মক, আপত্তিকর ও অগ্রহণযোগ্য। তিনি অপরাধের দায় ভিকটিম নারীদের উপর চাপিয়েছেন এবং তাদের বিচার পাওয়ার অধিকার অস্বীকার করেছেন। তার এই বক্তব্য গ্রহণ করা হলে বিবাহিত নারীরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বামীদের দ্বারা দিনের পর দিন ধর্ষিত হলে তারা বিচার পাওয়ার অধিকার রাখেন না।
আধুনিক সভ্যতা এবং বিদ্যমান আইন অনুযায়ী স্ত্রীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক করা ধর্ষণ। একজন যৌনকর্মীকেও তার অনিচ্ছায় আপনি জোর করতে পারবেন না। এটা রেপ। জজের বক্তব্য অনুযায়ী পেশাদার যৌনকর্মীদের উপর ধর্ষণের মতো জুলুম করা জায়েজ। কারণ যৌনকর্মীরা ফিজিকাল রিলেশনে অভ্যস্ত।
প্রশ্নবিদ্ধ অপসারন : ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ৭-এর বিচারক বেগম মোসা. কামরুন্নাহারের যেভাবে অপসারন করা হয়েছে প্রক্রিয়াটি স্বাধীন বিচার বিভাগের উপর হস্তক্ষেপ। আইন জগতের বোদ্ধারা ইতিমধ্যেই সমালোচনা করেছেন। বিচারকের অপসারনে যেভাবে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ দেখা গেছে তা স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রতি বৃদ্ধাংলি বলে মনে করেন আইনের তারা। বিচারকের এমন অপসারন একটা খারাপ নজীর হয়ে থাকলো। রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপীল না করে বিচারকের বিচারিক ক্ষমতায় নিষেধাজ্ঞা বিচার বিভাগের উপর নগ্ন হস্তক্ষেপের সামিল। ভুল হতেই পারে, যেমন ৭২ ঘন্টার পর্যবেক্ষণ সুপারিশটা উনার এখতিয়ার বহির্ভূত। হয়তো পুরো রায়টাই বায়াসড। কিন্তু এটা তো চূড়ান্ত কিছু না। সংক্ষুব্ধ যে কেউ এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল করতে পারবে। বিচার বিভাগের উপর এই হস্তক্ষেপের ফলে বিচারকরা অনেকটা সাহস হারাবে। সাধারণ মানুষের ভরসাস্থল আদালত আবারো প্রশ্নবিদ্ধ হল।
লেখক : লিগ্যাল (এস্টেট) অফিসার,
আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ