মাদকের কারণে দেশে আত্মহত্যা বেড়েই চলছে
- মাসুম বিল্লাহ
- প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১০:৩০ PM , আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১১:০২ PM
মাদক এমন একটি দ্রব্য যাহা গ্রহণ করলে তীব্র নেশার সৃষ্টি করে এবং পুনরায় গ্রহণ করার ইচ্ছা পোষন করে। ক্ষতি সম্পর্কে সম্মুখ ধারনা থাকা সত্তেও তীব্র নেশার কারনে পুনরায় গ্রহণ করার ইচ্ছা পোষন করে। সাধারণত ফেনসিডিল, হেরোইন, চোলাই মদ, বিদেশি মদ, প্যাথেড্রিন, ডিনেচার্ড স্পিরিট, বিয়ার, তাড়ি, বুপ্রেন রফিন(ইঞ্জেকশন), কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মেন্টেড ওয়াশ, গাঁজা, ভাং, চরস, আইস পিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টলুয়িন, পটাশিয়াম পারম্যাংগানেট, জর্দা, গুল, ইয়াবা, মিথাইল-ইথাইল কিটোন, ঘুমের ট্যাবলেটসহ সবকিছুই মাদকদ্রব্য। কোন ব্যক্তি যদি যে কোন একটিতে আসক্ত হয়ে হয় কিংবা গ্রহণ করে তখন তাকে মাদকাসক্ত বলে।বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য আইন ১৯৮৯ অনুসারে মাদকাসক্ত হচ্ছে,শারীরিক কিংবা মানসিক ভাবে মাদকে নির্ভরশীল ব্যক্তিকে বুঝায়। এছাড়া আন্তর্জাতিক সংগঠন হু (WHO) এর মতে Intoxication is determental to the individual and the society produced by the repeated consumption of a drug.
মাদকের ক্ষতি সম্পর্কে কমবেশি প্রত্যকেরই জানা। মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। মাদক মানুষের জীবনে বহুমুখী ক্ষতি সাধন করে। বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হলেও ভৌগোলিক অবস্থানের কারনে খুব সহজেই দেশে মিলছে মদ, আর সেই মদের নিশানি হচ্ছে যুবক -যুবতীরা। বিশেষ করে ভারত, মিয়ানমার, লাওস, থাইল্যান্ডসহ আরও অনেক দেশে মাদক উৎপন্ন হয়। আন্তর্জাতিকভাবে মাদক পাচার করতে দেশের ট্রানজিট ব্যবহার করার কারনে সহজেই মাদক প্রবেশ করছে—যা রোধ করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।
মাদকের ব্যবসায় অধিক মুনাফা অর্জন করায় ব্যবসায়িদের সংখ্যা বাড়ছে। তারা একাধিক উৎস থেকে মদ সংগ্রহ করে গোপনে বাজারজাত করছে। বন্ধু-বান্ধব কিংবা সহপাঠীদের কাছ থেকে অনেকে মদ সংগ্রহ করে। বস্তি কিংবা শহরের টোকাই ছেলেদের কাছ থেকেও অনেকে সংগ্রহ করে।
মাদকে আসক্ত হওয়ার প্রধান কারণ হলো ব্যর্থতা বা পরাজয় মানতে না পারা। অনেকে ব্যর্থতার গ্লানি সহ্য করতে না পেরে মাদকের দিকে ঝুকে পড়ে। এছাড়া আরো বেশ কয়েকটি কারন আছে যেমন, উত্তেজনা, একঘেয়েমিতা, পারিবারিক অশান্তি, মানসিক অশান্তি, কোনো কাজে বার বার ব্যর্থ হওয়া, একাকিত্ব, বিবাহ বিচ্ছেদ, প্রেমে ব্যর্থতা ইত্যাদি। আবার কেউ শখের ছলে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মাদক গ্রহণ করে। দেশের স্বনামধন্য ক্লাবগুলাতে সরকারী লাইসেন্স নিয়ে চলে মদের পার্টি, যেখানে আসে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের একাংশ, চলচিত্র জগতের তারকা,বড় বড় ব্যবসায়ী, উচ্চবিলাসী ব্যক্তিবর্গসহ নানান পেশার মানুষ।
মাদকের কুফল সুদুরপ্রসারি, উপকার একদম নেই। মাদক কোনো কিছুই দেয় না বরং সবকিছু কেড়ে নেয়। মাদকসেবীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি মানসিক বিকারগ্রস্তও হয়। দীর্ঘদিন মাদক সেবনের ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, স্নায়ুবিক দুর্বলতা সৃষ্টি করে, ক্যান্সার সৃষ্টি করে, ইনঞ্জেকশনের মাধ্যমে মাদক নেওয়ার সময় HIV ভাইরাসে সংক্রমিত হয় এবং অনেক সময় মাদকে টক্সিক পাদর্থ উৎপন্ন হয় যাহা গ্রহণ করার পর পরেই মানুষ মারা যায়।
মাদকসেবীদের আচরন আর স্বাভাবিক মানুষের আচরনের মধ্যে বিরাট তারতাম্য দেখা যায়। পৃথিবীতে যত অপকর্ম ঘটে তার বেশির ভাগই মাদকসেবীদের দ্বারা সংগঠিত হয়। তারা ন্যায় অন্যায় বুঝে কাজ করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলে, খুব সহজেই মানুষকে খুন করতেও পিছপা হয় না। বাংলাদেশে নারী নির্যাতন ও যৌন হয়রানি একটা কমন বিষয়,প্রতিনিয়ত এমন ঘটনা ঘটেই চলছে। খোঁজ নিলেই দেখা যায়, তাদের অধিকাংশই মাদকসেবী। বর্তমানে এমন কিছু খারাপ ঘটনা ঘটছে— যা সিনেমার অভিয়নকেও হার মানায়। এই সব কিছুর জন্য মাদক দায়ী।
মাদকের ছোবল সারা দেশে ছড়িয়েছে । শুধু শহরেই নয়, গ্রামে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে মাদকদ্রব্য। তার বিষাক্ত ছোবল শেষ করে দিচ্ছে তরুণ-তরুণীদের শক্তি ও সম্ভাবনা। মাদক ধ্বংস করে একটি মানুষের শরীর, মন, জ্ঞান-বিবেক ও তার জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা পরিবারের সকল স্বপ্ন ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। পরিবারের পাশাপাশি সমাজকেও ধ্বংস করে দিচ্ছে মাদক। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হুমকির মুখে ফেলছে এই মাদকই। বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন পথে, মাদক ঢুকে পড়ছে আমাদের সমাজে— এতে ছাত্রসমাজের একাংশ ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। এছাড়া আত্মহত্যাও দিনদিন বেড়েই চলছে।
মাদককের ছোবল থেকে যুব সমাজকে রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। মাদক নির্মুলে সরকারি অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে।যুব সমাজ যাতে মাদকে আসক্ত হয়ে না পড়ে,সেজন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও সমাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পাড়ায়-মহল্লায়, স্কুল-কলেজ,-বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা হাটে- বাজারে ক্যাম্পেইন করে মাদকের ভয়াবহতা তুলে ধরতে হবে। এ যুগের বড় একটা অংশ সামাজিক যোগাযোগ কিংবা ফেইসবুকে থাকে, এই মাধ্যমকেই কাজে লাগানো যেতে পারে। ফলে খুব সহজেই যুব সমাজ এটা বুঝতে পারবে।
মাদকের চোরাচালান রোধ করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো কঠোর হতে হবে। প্রাইমারী স্কুল থেকে শুরু করে সকল ক্লাসের বইয়ে মাদকের ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরতে হবে। পরিবারের কেউ যাতে মাদকদ্রব্যে গ্রহণ কিংবা বিপননের সাথে সম্পৃক্ত না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখা এবং পারিবারিক সম্প্রীতি বজায় রাখা, সন্তানের সামনে স্বামী-স্ত্রী বিরোধ না করা, নিজেরা মাদকমুক্ত জীবনযাপন এবং সন্তানদের ছোটবেলা থেকে মাদকমুক্ত জীবন যাপনের নৈতিক শিক্ষা দেওয়া, নিজে ধর্মীয় বিধিনিষেধ মেনে চলা, পরিবারে কিংবা সমাজে এই বিষয়ে সচেতন করা।
মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে ঘৃণা না করে, কৌশলে ভালো পথে নিয়ে আসা যায়। আসলে পরিবারে সবাই মিলেমিশে থাকার মধ্যে দিয়েই মাদক মুক্ত সমাজ গড়া সম্ভব।
লেখক: শিক্ষার্থী, বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়