রম্যরস: ম্যান ভার্সেস ঢাকা ইউনিভার্সিটি!
প্যারাসুট নিয়ে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের মাঠে অবতরণ করে বিয়ার গ্রিলস। দেখলেন পাশে কিছু অন্ধকার ও ঘিঞ্জি টিনশেডের রুম। কৌতুহলবশতঃ রুমগুলোর দিকে দৌঁড়ে গেলেন তিনি। রুমগুলোর অবস্থা দেখে বিয়ারের চোখ দুটো তো ছানাবড়া! মধ্যম আয়ের একটি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের আবাসিক হলের চিত্র এটি! রুমগুলোর ভেতরে উঁকি দিয়ে তিনি নিজের চোখকে অবিশ্বাস করা শুরু করলেন। দ্রুত গুগল ম্যাপে ঢুকে চেক করে নিলেন তিনি কি আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন নাকি ইরাকের আবু গারিব কারাগারে!
ছোট একটি রুমের মধ্যে ৩০-৩৫জন ছাত্র অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় বসবাস করছে। তিনি মনে মনে ভাবলেন, এখানে থেকে আর যাই হোক, পড়াশোনা সম্ভব না। সেখানে বসবাসরত শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করলে তারা জানালো; এসব গনরুম। ঠিক এ সময় পাশ থেকে একজন পাতিনেতা বিয়ারকে গণরুমের উপকারিতা বর্ণনা করা শুরু করলো। পাতিনেতা বললো, এসব গনরুম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য। এখানে থেকে অনেক শিক্ষা অর্জন করা যায়। বন্ধুদের মধ্যে ভালো বন্ডিং তৈরি হয়।
যাই হোক, সামনে এগুতে থাকলেন বিয়ার গ্রিলস। হলের সামনে গিয়ে দেখলেন একদল শিক্ষার্থী গগনবিদারী আওয়াজ তুলে স্লোগান দিচ্ছেন। জহু হলের মাটি...! রক্তের বন্যায়...! বিয়ার কিছু বুঝতে না পেরে কানে আঙুল দিয়ে সোজা রাস্তায় চলে আসলেন। প্রচন্ড খিদা পেয়েছে তার। ব্রেকফাস্ট করতে হবে। ভাবলেন, সব এডভেঞ্চারে তো পোকামাকড় দিয়ে ব্রেকফাস্ট করি। এবার বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে এডভেঞ্চারে এসেছি। নিশ্চয়ই এবার একটা ফাটাফাটি ব্রেকফাস্ট হবে। কিন্তু সারা ক্যাম্পাস খুঁজে পাউরুটি, ডিম ও কলা ছাড়া তেমন কিছুই পেলেন না তিনি। ফাটাফাটি ব্রেকফাস্টের আশা ছেড়ে দিয়ে তিনি স্যার এএফ রহমান হল থেকে পাউরুটি আর কলা খেয়ে হলটা ঘুরে দেখলেন। এখানেও শিক্ষার্থীদের মানবেতর জীবনযাপনের চিত্র দেখলেন তিনি। হল থেকে বেরিয়ে তিনি ক্যাম্পাসের অন্যান্য জায়গা আবিষ্কারে বেরিয়ে পড়লেন। ভিসি চত্বরে গিয়ে তিনি দেখলেন দুই গ্রুপ কুকুর তুমুল সংঘর্ষে লিপ্ত। ব্যাপক ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছে। হঠাৎ একটা কুকুর বিয়ারের দিকে তেড়ে আসলো। ঘেউ! ঘেউ! বিয়ার কোনোমতে প্রাণটা নিয়ে সূর্যসেন হলের দিকে দিলেন ভৌ দৌঁড়!
সেখান থেকে বিজনেস ফ্যাকাল্টি হয়ে মধুর ক্যান্টিনের কাছাকাছি গিয়ে তিনি আবারও গগনবিদারী স্লোগানের আওয়াজ শুনলেন। ক্যান্টিনের সামনে গিয়ে দেখলেন একদল শিক্ষার্থী ক্যান্টিন ঘিরে আছে আর স্লোগান দিচ্ছে। তখন সময় প্রায় বারোটা বাজে। সেখানে সকালে জহু হলের সামনে স্লোগান দেয়া শিক্ষার্থীদেরও দেখতে পেলেন তিনি। তাদের স্লোগানের উচ্চ আওয়াজে পাশের সামাজিক বিজ্ঞান ভবন ও কলা ভবনে শিক্ষার্থীরা কিভাবে ক্লাস করছে তা ভেবে বেশ অবাকই হলেন তিনি।
অতঃপর চারুকলা থেকে টিএসসি হয়ে সোজা চলে এলেন কার্জন হল। সেখান থেকে ঢাকা মেডিক্যাল। ঢাকা মেডিক্যালে যাওয়ার পথে খুব বিশ্রী একটা দুর্গন্ধ নাকে আসলো। এরকম দুর্গন্ধের স্বাদ তিনি ইতোপূর্বে কখনো আস্বাদন করেননি। প্রায় বমি চলে আসলো বিয়ারের। মেডিক্যালে ঢুকে তিনি দেখলেন সেখানে চরম বিশৃঙ্খলা চলছে। হাসপাতাল তো নয় যেন মগের মুল্লুক। সেখান থেকে তিনি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার আসলেন। দেখলেন শহীদ মিনারের বেদীতে জুতা পরে আড্ডা দিচ্ছে মানুষ। এছাড়াও চারিদিকে শুয়ে আছে অসংখ্য ভবঘুরে, পাগল ও মাদকাসক্ত।
এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে দুপুর হয়ে গেল। লাঞ্চ করতে হবে। সূর্যসেন হল ক্যাফেটারিয়ায় এসে ঢুকলেন তিনি। ভাবলেন, ব্রেকফাস্ট তো মন মতো হয়নি; লাঞ্চটা অন্তত একদম ভরপেট খাবো। খাবার নিয়ে মুখে দিতেই বিয়ারের মুখটা বাংলার পাঁচের মতো হয়ে গেল! অস্ফুটস্বরে বলে উঠলেন, কি বিস্বাদ খাবার রে বাবা! এর চেয়ে সাইবেরিয়ায় খাওয়া মরা হরিণের মাংসটা আরো সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ছিলো। এসব খাবার কীভাবে খায় শিক্ষার্থীরা? পুষ্টি তো দূরের কথা, উল্টো স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার খেলে।
যাই হোক, খাওয়া-দাওয়া করে সবুজ চত্বরে এসে একটু বিশ্রাম নিতে শরীরটা এলিয়ে দিতেই ঘুম চলে আসলো তার। ঘুম থেকে উঠে দেখলেন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে টিএসসি চলে এলেন তিনি। কিন্তু টিএসসিতে মানুষের ভীড়ে হাঁটা দায়। তিনি ভাবলেন, এটা কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নাকি ইস্তাম্বুলের গ্র্যান্ড বাজার? টিএসসিতে হালকা চা-নাশতা করে পায়রা চত্বরে কয়েকজন শিক্ষার্থীদের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে তিনি চলে আসলেন ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। উদ্যানে ঢুকে ডান দিকে কিছুদূর গিয়ে দেখলেন কিছু মানুষ বসে আছে। সেখান থেকে আসছে একটা উদ্ভট গন্ধ। বুঝতে দেরী হলো না, এটা গাঁজার গন্ধ। কিছুক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ খেয়াল করলেন তাকে কয়েকজন লোক অনুসরণ করছে। অবস্থা সুবিধার না দেখে তিনি দ্রুত হাঁটা শুরু করলেন। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারলেন না। তিনজন লোক এসে ঘিরে ধরলো তাকে। হাতে চাকু। উপায়ন্তর না দেখে টাকা পয়সা, মোবাইল সব বের করে দিলেন তিনি। বেচারা দুঃখ মনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অ্যাডভেঞ্চার স্থগিত করে হলের দিকে চলে আসলেন।
বঙ্গবন্ধু হলের ক্যান্টিনে আবার সেই অখাদ্য খেয়ে হলের গেস্টরুমে একটু বসার জন্য গেলেন তিনি। কিন্তু গেস্টরুমের দরজা আটকানো। জানালা দিয়ে তিনি সেখানে এক অদ্ভুত কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করলেন। দেখলেন, ৫-৬জন পাতিনেতা সোফায় হেলান দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে নবাবী স্টাইলে বসে আছে। তাদের সামনে আসামীর মতো জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ২০-২৫জন ছাত্র। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া একজন ছাত্রের কাছে এখানে কি হচ্ছে জানতে চাইলে ছাত্রটি বললো সেখানে নাকি ‘গেস্টরুম’ নেয়া হচ্ছে। যারা সোফায় বসে আছে তারা দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের পাতিনেতা আর যারা দাঁড়িয়ে আছে তারা হলের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি দেখলেন, সোফায় বসে থাকা ‘নবাব’রা সেই জুনিয়র শিক্ষার্থীদের খুব ধমকাচ্ছে, জোরে জোরে চিল্লাচিল্লি করছে। তাদের হুমকি-ধমকিতে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের প্রাণ যায় যায় অবস্থা। তিনি ভাবলেন, যে সময় অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরিতে পড়াশোনায় মগ্ন থাকে সে সময় এখানকার শিক্ষার্থীরা দাদাগীরিতে ব্যস্ত। বড়রা তো নিজেদের সময় নষ্ট করছেই, সাথে সাথে ছোটদের সময়ও নষ্ট করে তাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্থ করে দিচ্ছে।
এসব কর্মকাণ্ড দেখে তার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। শরীরটাও ক্লান্ত। ঘুমাতে হবে। রাতটা কাটানোর জন্য তিনি গেলেন বিজয় একাত্তর হলে। হলটা নতুন ও সুন্দর। ঘুমানোর জন্য গণরুমে গেলেন তিনি। হলের গেইট দিয়ে প্রবেশ করার করার সময় একজন বলেছিলো এই হলের গণরুম নাকি এশিয়ার বৃহত্তম গণরুম! ঢুকে দেখলেন আসলেই!
‘এশিয়ার বৃহত্তম গণরুমে’ ঢুকে মনে হলো যুদ্ধবিধ্বস্ত কোনো দেশ থেকে পালিয়ে আসা শরনার্থী শিবিরে এসে পড়েছেন তিনি। পুরো রুম শিক্ষার্থীতে ভর্তি। তাদের ব্যাগপত্র, ট্রাংক ও কাপড়চোপড়ে ঠাসা। কোথাও এতটুকু জায়গা খালি নেই। শিক্ষার্থীরা সব ইলিশ ফাইল হয়ে শুয়ে আছে। তবুও তিনি এককোনায় একটা জায়গা করে নিলেন। কিন্তু যখনই শরীরটা একটু এলিয়ে দিলেন, দেখলেন অগণিত ছারপোকা তার রক্তকে তাদের পৈতৃক সম্পত্তি মনে করে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে! পাশাপাশি প্রচন্ড গরম সইতে না পেরে মাঠে গিয়ে শুয়ে পড়লেন বিয়ার গ্রিলস। সিদ্ধান্ত নিলেন আর নাহ! সকাল হলেই অ্যামেরিকার ফ্লাইট ধরবেন। অ্যামাজন, সাইবেরিয়া, সাহারা মরুভূমির মতো জায়গায় সার্ভাইভ করতে পারলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্ভাইভ করা তার পক্ষে সম্ভব না!