আন্দোলন বানচালে শিক্ষার্থীদের বিভক্ত করছে প্রশাসন
বছর খানেকেরও বেশি সময় ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল-ক্যাম্পাস ‘বন্ধ’ আছে। তবে সম্প্রতি শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর হল-ক্যাম্পাস খুলে দেয়ার দাবি জোরালো হতে থাকে। ঐ ‘বন্ধ’ থাকার প্রকৃতিটা কেমন, প্রথমে তা দেখা যাক। ‘বন্ধ’ ক্যাম্পাসে দৈনিক শত শত মানুষ আসে, কেউ টিকটক বানায়, কেউ পার্ক মনে করে ঘুরতে আসে, কেউ মাদক বেচাকেনা করে। এসব দেদারসে চলছে সেই ক্যাম্পাসে, যা করোনা সংক্রমণের দোহায় দিয়ে ‘বন্ধ’ রাখা হয়েছে।
আদতে, ক্যাম্পাস খোলাই আছে। কেবল শিক্ষার্থীদের ক্লাস করার অধিকারটুকু কেড়ে নেয়া হয়েছে। হল ‘বন্ধ’ রাখার ব্যাপারটা কেমন সেটাও দেখা যাক। মার্চের প্রথম সপ্তাহে সংবাদ মারফত আমরা জানতে পারি ছাত্রলীগের কিছু নেতা দিব্যি হলে থাকছেন। (সূত্র: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস) প্রশাসন হল ছাড়ার নোটিশ দেয়া সত্ত্বেও নাকি তারা ছেড়ে যাননি। অর্থাৎ, ‘বন্ধ’ ক্যাম্পাস ও ‘বন্ধ’ হল আদতে ক্ষমতাহীন সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্যই।
অথচ ‘বন্ধ’ ক্যাম্পাস থেকে ডাকসুর সদ্য সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, প্রগতিশীল ছাত্রজোটের উপর হামলা হয়, টিএসসি থেকে আতিক মোর্শেদদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথম আলোর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আসিফ হিমাদ্রি এবং জাগোনিউজের আবিদুর রাসেল ছাত্রলীগের সরাসরি হামলার শিকার হন। সর্বশেষ, গতকাল ছাত্রদলের উপর হামলা হয়। সেখানে ঢাকা পোস্টের আমজাদ হোসেন হৃদয়ও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের হাতে লাঞ্চিত হন।
এটাই ‘বন্ধ’ ক্যাম্পাসের স্বরূপ। অথচ আখতার হোসেনের গ্রেফতারের প্রতিবাদে আয়োজিত সমাবেশও পন্ড করা হয় ‘বন্ধ’ ক্যাম্পাসের দোহায় দিয়েই। হাফিজুরের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর সাধারণ শিক্ষার্থীরাই হল-ক্যাম্পাস খুলে দেয়ার দাবিতে অনলাইনে সোচ্চার হন। কারণ, আরেকটা প্রাণ এভাবে অবহেলায় ঝরে যাক, তা কেউই চায় না।
তারই পরিপ্রেক্ষিতে এই দাবি আন্দোলনে রূপ নেয়। এবং আন্দোলনের মৌলিক দাবি ছিল এটাই- ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে হল-ক্যাম্পাস খুলে দাও’। আন্দোলনের অংশ হিসাবে সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদের নেতৃত্বে আন্দোলনকারীরা ভিসি স্যারের কাছে স্মারকলিপি দিতে যান। আসিফ মাহমুদের ভাষ্যমতে, আন্দোলনকারীদের ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত’ বলেন ভিসি স্যার।
যাহোক, আন্দোলন বেশ সক্রিয় অবস্থানে যখন, তখনই পুরানো ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ পলিসি খেললো প্রশাসন। তারা বললো- ‘ঠিকাছে বাবারা! তোমাদের পরীক্ষা নেবো, তবে হল খুলবো না।’ এতোদিন ছাত্রলীগসহ সিংহভাগ শিক্ষার্থী যখন হল-ক্যাম্পাস খোলার দাবিতে একমত ছিল, তারা এবার প্রথমবারের মতো বিভক্ত হলো। অনেক শিক্ষার্থী আন্দোলনকারীদের দোষ দেয়া শুরু করলেন। অথচ একবারের জন্যও ভেবে দেখলেন না যে, আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল ‘হল খুলে পরীক্ষা নেয়া’। সেখানে প্রশাসন হল না খুলে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক ও অমানবিক।
তারপর কেউ কেউ বলে বসলেন, ‘এরচেয়ে তো অনলাইনে নিলেই ভালো হতো। শুধু শুধুই আন্দোলন করে ভেজাল লাগালো।’ (এর চেয়েও কটু মন্তব্য বিশ্ববিদ্যালয় গ্রুপগুলোতে বিদ্যমান) অথচ তারাও যদি ফেসবুকে বকবক না করে রাজপথে আসতো এবং প্রশাসন যদি দাবি মেনে নিতো, তাহলে আন্দোলনের সুফল সবাই ভোগ করতো। এখন প্রশাসন নানা টালবাহানা করছে, তার জন্য প্রশাসনকে দায়ী না করে শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ আন্দোলনকারীদেরই দায়ী করে বসছে। এটা প্রাশাসনিক চাল বুঝতে না পারা ও সংকীর্ণ চিন্তার ফল।আন্দোলনকারীরা হয়তো ভাবছেন - 'যার জন্য করি চুরি, সেই বলে চোর।'
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গতমাসে ঘোষণা করেছে অনলাইনে ‘লাইভ এক্সামে’র মাধ্যমে ফাইনাল পরীক্ষা নেয়া হবে; এসাইনমেন্টের ভিত্তিতে না। এবং ভিসি স্যারের কাছে স্মারকলিপি দিতে গেলে, এসাইনমেন্টের ব্যাপারে তিনিও না-সূচক মন্তব্য করেছেন বলে আন্দোলনকারীরা জানিয়েছে। সুতরাং, প্রথমেই এসাইনমেন্টের কথা মাথা থেকে ঝাঁড়তে হবে। 'লাইভ ক্লাস' যেখানে মাঠে-ঘাটে গিয়ে করতে হয়, সেখানে ২-৩ ঘন্টার লাইভ এক্সাম কি মাঠে বা পুকুর ঘাটে বসে দিবে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা? যারা শহরে বা মফস্বলে আছেন, তারা গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের কথাও ভাবুন। ১ ঘন্টার টার্ম-টিউটোরিয়ালে তাদের অংশগ্রহণ দেখে ভাববেন না যে, খুব কম্ফোর্টেবলি তারা পরীক্ষা দিয়েছে। সবাই সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির নন। একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস দেয়া, আর লাইভ এক্সামে বসা এক কথা না। এসাইনমেন্ট হলে সেটা ভিন্ন ব্যাপার। তার উপর ল্যাপটপ অথবা নূন্যতম দুইটি ডিভাইস ছাড়া ‘লাইভ এক্সাম’ দেয়া আদৌ সম্ভব কি না? আমার ফোনে তো গুগল ক্লাসরুমে ডুকলে জুম থেকে অটোমেটিকালি বের হয়ে যায়। আমার ল্যাপটপও নেই, আমি কি করবো বলতে পারেন কেউ?
অনেকে বলছেন- ক্লাস নিয়েছে অনলাইনে তাহলে পরীক্ষা কেন অফলাইনে হবে? তারপর হাল্কা করে আন্দোলনকারীদের গালি দিচ্ছেন। অফলাইনে ফুল মার্কসের পরীক্ষা নিলে অনেকে ফেল করতে পারেন বলে শঙ্কাবোধ করছেন। আমি নিজেও শঙ্কিত। বোধ করি, এখান থেকেই এই দাবির উৎপত্তি। অথচ এটাও কি প্রশাসনের দায় নয়? তারা কি জানে না, অনলাইনে শিক্ষার্থীদের কেমন পড়াশোনা ও দিকনির্দেশনা তারা দিতে পেরেছে? সুতরাং, সে অনুযায়ী পরীক্ষার্থীদের কীভাবে মূল্যায়ন করা উচিত তা অনলাইনে হোক কিংবা অফলাইনে? এর দায়ভারও কেন আন্দোলনকারীরা নেবে? আন্দোলনকারীরা কি বাঁধাধরা নিয়মে ফুল-মার্কসের পরীক্ষা নিতে আন্দোলনে নেমেছে?
সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত দাবির মুখেই এই আন্দোলনের সৃষ্টি। আন্দোলনকারীরা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে চেষ্টা করেছেন। তাদের দোষ দেয়াটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক। বরং প্রশাসনের 'ডিভাইড এন্ড রুল' পলিসি ভালোভাবে বুঝতে পারলে আমরা দোষীদের চিনতে পারবো। কারা দিনে এক কথা, রাতে এক কথা বলে শিক্ষার্থীদের দোদুল্যমান অবস্থায় রেখেছে। কারা একবার স্বশরীরের পরীক্ষা নিতে রাজি, তো আবার হল খুলতে নারাজ। শিক্ষার্থীদের কারো কারো মনে এই ভয়ও আছে যে, আন্দোলনে সম্মত হয়ে ক্যাম্পাস খুলে দিলে করোনা সংক্রমণ হলে পরে তার দায়ভার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিবে না। আমি বলি আলবৎ নিতে হবে। ৪/৮ জনের রুমে গাদাগাদি করে ৩০ জন রাখা হলে, সেটা মনিটর করার দায়িত্ব কার? বৈধ ছাত্রদের হলে সিট এলোট দেয় না কারা? হলে অছাত্র ও বহিরাগতদের দৌরাত্ম থামাতে ব্যর্থ কারা?
দুয়েকজনের কটু কথায় আশা করি আন্দোলন থেমে থাকবে না। আন্দোলন নিজস্ব গতিতে চলমান থাকবে। আর যারা মনে করেন আন্দোলনকারীদের আন্দোলনই সমস্ত নষ্টের মূল, তাদের প্রতি আহবান আপনারা পাল্টা একটা আন্দোলন দাঁড় করিয়ে উনাদের ইনভ্যালিডেট করে দিন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আপনাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে বলেই আমার বিশ্বাস।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ ও দপ্তর সম্পাদক, ছাত্র অধিকার পরিষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।