বাবু-বিবি সাংবাদিক (১ম থেকে তৃতীয় পর্ব)
(প্রথম পর্ব)- ঊনবিংশ শতকে ঢাকা-কোলকাতার বাবুরা নিজেদের বাগানবাড়িতে রক্ষিতা রাখতেন। ‘আমি চৌঘুড়ি বাজিয়ে যাবো, সঙ্গেতে ইয়ার’। রামকুমারের গাওয়া গান। ইয়ারদোস্তদের নিয়ে, হাতে বেলিফুলের মালা জড়িয়ে একেক বাবু চার ঘোড়ার গাড়িতে করে বাগানবাড়িতে যাচ্ছেন রক্ষিতাসন্দর্শনে- এটা শহর কলিকাতার প্রতি পড়ন্ত বিকালের চিরাচরিত ঘটনা।
রক্ষিতা না রাখলে, বিয়ে করা বৌয়ের সঙ্গে রাত কাটালে সে যুগের সমাজে বাবুদের ছিছিকার হতো। রাজা রামমোহন রায়েরও মুসলমান রক্ষিতা ছিল বলে শুনেছি। মুসলমান নবাবদেরও হিন্দু রক্ষিতা ছিল। বাবুর মৃত্যু হলে কিংবা ধনের জোর কমে গেলে রক্ষিতারা বাবু বদলাতেন। ‘সেই সময়’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ইত্যাদি উপন্যাস রক্ষিতার উপাখ্যানে পরিপূর্ণ।
রক্ষিতারা নিজ নিজ বাগানবাড়িতে বিপুল সংখ্যক ঝি-চাকর নিয়ে রানীর হালে থাকতেন। যে যার মতো স্বধর্ম পালন করতেন। বাবুর স্ত্রীকে তারা অসম্মান করতেন না, বাবুর পুত্রকন্যাকে আপন সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। ছেলেমেয়েও মানুষ করতেন তারা। কলিকাতার রক্ষিতা হীরামণ তার ছেলেকে হিন্দু কলেজে ভর্তি করতে গেলে বিদ্যাসাগরের সমর্থন সত্ত্বেও সমাজপতিরা তার ভর্তির অনুমোদন দেয়নি। দানধর্মও করতেন রক্ষিতারা। শ্রীকান্ত উপন্যাসে রাজলক্ষ্মী স্বগ্রামে পুকুর কাটিয়েছিলেন, কিন্তু গ্রামবাসী সেই পুকুর তাকে উৎসর্গ করতে দেয়নি এবং পুকুরের জল পারতপক্ষে ব্যবহার করতো না।
রক্ষিতারা নিজের সীমা জানতেন। তারা কখনই বাবুকে বিয়ে করার আবদার করতেন না, কারণ সমাজ সেটা মেনে নিত না। বাবুদের বৌয়েরাও নিজের সীমা জানতেন। তারা রক্ষিতাকে বেঘর করার চেষ্টা করতেন না। একটি নারীর সঙ্গেই সম্পর্ক থাকবে - এমন চিন্তা ঊনবিংশ শতকের সমাজে ‘অদ্ভুত’ বলে পরিগণিত হতো। অতিসংবেদনশীল রক্ষিতাদের আত্মহত্যার ঘটনা তখনও যে ঘটতো না তা নয়। ভূতের গল্পে কোনো কোনো রক্ষিতা মরে পত্নির বদলে পেত্নি হয়ে বাবুর উপর প্রতিশোধও হয়তো নিত। কিন্তু এগুলো ব্যতিক্রম।
সংস্কৃত ‘রক্ষিতা’ বা এর হিন্দি তদ্ভব ‘রাখোয়াল’ শব্দের পুংলিঙ্গ বাচক শব্দ ‘লুচ্চা’। শব্দটি বাবুদের সম্পর্কে কখনও ব্যবহার করা হতো না, লেখায় দূরে থাক, মুখেও নয়। সে যুগের সমাজটাই অন্য রকম ছিল। ‘রক্ষিতা’ও যে তখন এমন কিছু খারাপ শব্দ ছিল তাও নয়। সে যুগের সাংবাদিকেরা নিজের সীমা জানতেন। রামমোহন রায়ের নামের আগে তারা ‘রাজা’ই লিখতেন, ‘লুচ্চা’ নয়।
‘হায়! সেই বাবুও নাই, সেই রক্ষিতাও নাই!’ যদি কেউ বলে তবে সে মিথ্যা বলছে। ‘মধ্যযুগীয় সমস্যা বলে কিছু নাই, মধ্যযুগীয় সমাধান আছে।’ সব যদি ভিতরে ভিতরে আগের মতোই থাকে, তবে একা সাংবাদিকের উপরই বা সাহসী ও দায়িত্ববান হবার দায় বর্তাবে কেন? সাংবাদিকেরা সমাজেরই অংশ। সমাজ পরিবর্তন সাংবাদিকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। সমাজ যেভাবে ভাবে, সাংবাদিক সেভাবেই ভাবতে বাধ্য হয়।
চুঙার কাজ আগুনে ফুঁ দেওয়া, কুত্তার বাঁকানো লেজ সোজা করা চুঙার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তাছাড়া আগুনই যেখানে নিভে গেছে, সেখানে ফু দিলেই বা কি! বারো বছর চুঙায় রাখলেও কুত্তার লেজ সোজা হয় না বলে শুনেছি।
দ্বিতীয় পর্ব
গুলশানের একটি ফ্ল্যাটে খুন হয়েছে কিংবা আত্মহত্যা করেছে একটি কলেজ-পড়ুয়া মেয়ে যার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল একটি শিল্পগোষ্ঠীর মালিক এমডির। খবরটা দিয়েছে সংবাদপত্র কিংবা সাংবাদিকেরাই। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা মেয়েটির তথাকথিত প্রেমিকের বিরুদ্ধে যথেষ্ট পরিমাণে লিখছেন না, বরং মরহুমার চরিত্র হনন করছেন এই বলে যে তিনি কাপড় বদলানোর মতো প্রেমিক বদলাতেন। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যে মুনিয়া জীবিত না থাকার সুযোগে জনমনে দোষের পাল্লা মৃত মুনিয়ার দিকে যদি কোনমতে ভারি করা যায়, তবে প্রকৃত বিচার শুরু হবার আগেই এমডি’র দিকের পাল্লা স্বয়ংক্রীয়ভাবেই হাল্কা হয়ে পড়বে।
‘পাখিটার বুকে যেন তীর মেরো না।’ করোনা-আকালে স্কুল-কলেজ সব বন্ধ। সব পাখি যখন নীড়ে ফিরে গেছে, তখন একা, তরুণী একটি মুনিয়া কোন সাহসে ঢাকার জঙ্গলে উড়ছিল? এটা ঠিক যে মোবাইল ফোনের এই যুগে ঢাকায় থেকেই শিকারির পক্ষে কুমিল্লার পাখি পাকড়াও করা অসম্ভব নয়। কোন উদ্দেশ্যে মাসে লক্ষ টাকা দিয়ে গুলশানে মুনিয়ার জন্যে সোনার খাঁচা নিজের নামে ভাড়া করেছিল মুনিয়ার নিকট আত্মীয়েরা? শিকারি ধোয়া তুলসীপাতা অবশ্যই নয়, কিন্তু শিকারির পাতা মরণ ফাঁদকেই মুনিয়ার মৃত্যুর একমাত্র কারণ ভেবে নেয়াটা শিশুতোষ হবে। একাধিক পক্ষের জন্যে বেচারা মুনিয়া হয়তো ছিল সোনার ডিমপাড়া এক রাজহংসী, পেটকাটার পরেই যে নীতিগল্পের নায়িকা হয়ে ওঠে।
আরেক শিকারি, যিনি ঝর্ণার আশেপাশে শিকার করতেন, তিনি এখন কারাগারে। সামাজিক গণমাধ্যমে এই দুই লুচ্চা বাবুর তুলনা করা হচ্ছে। আগের দিন হলে এই শিকারিদের উপজীব্য করে কালীঘাটের পট আঁকা হতো। এক যাত্রায় কেন পৃথক ফল হবে? একই ধরনের অপরাধে একজন কারাভোগ করবে এবং অন্যজন কেন বহাল তবিয়তে থাকবে বা মতান্তরে বিদেশ চলে যাবে - এই প্রশ্নগুলো জনমনে বা সামাজিক গণমাধ্যমে উঠছে।
তৃতীয় ও সর্বশেষ পর্ব
প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবার দায় সাংবাদিকের নয়, রাষ্ট্রের বা সরকারের। হাজার হিসাব করে সরকারকে একেকটি সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ নিতে হয়, যার কোনোটা আপনার চোখে ভুল হতে পারে, কিন্তু আপনি ক্ষমতায় থাকলেও কি সব কিছু শুদ্ধ করতে পারতেন? গত পঞ্চাশ বছরে আমরা দেখেছি, সরকারগুলো নিজের সুবিধা অনুসারেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সব সময় এবং পৃথিবীর সব সরকারই অনুরূপভাবে কাজ করে থাকে। এতে সরকারের কখনও সুবিধা হয়েছে, কখনও শিব গড়তে হয়েছে বানর।
ক্ষমতা একটা দাবাখেলা। শতরঞ্জ কী খিলাড়ী যত চিন্তাভাবনা করেই দান দিক না কেন, প্রতিটি দান সঠিক নাও হতে পারে, হিতে বিপরীত হতে পারে কখনও - এই ভয়ও সরকারের আছে বৈকি। শিকারি এমডি একা নয়, তার পিছনে আছে যে একটি প্রতিষ্ঠান, লাখ খানেক শ্রমিক-কর্মচারী, তাদের কথা, প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত বিচিত্র ও বহুসংখ্যক কুশীলবদের কথাও হিসেবে নিতে হয় বৈকি সরকারকে। শ্রেফ ন্যায়-অন্যায়ের কথা মাথায় রেখে হুট করে কোনো সরকারই সিদ্ধান্ত নেয় না, নেয়া যায় না। সাম-দান-ভেদ-দণ্ড - চাণক্য কথিত এই চারটি সিদ্ধান্তক্রম সরকারকে অনুসরণ করতেই হয়।
লিখে যাদের পেট চলে, লেখার উপর যাদের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নির্ভর করে, তারা ইচ্ছা হলেই প্রতিবাদ করতে পারে না। পেটের দায়ে সাংবাদিকদের তাই লিখতে হয়, যা তাদের লিখতে বলা হয়। হুকুমের গোলাম। হুকুম পালন করতে গিয়ে, যা লেখার ইচ্ছা, যা লেখা উচিত, তা লিখতে না পেরে গোলামের মনোকষ্ট অবশ্যই হয়, কিন্তু গোলামের কলমের কালিটাই আপনার চোখে পড়ে, তার চোখের জল আপনার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। সাহেব-বিবি-গোলাম। বিনাপ্রতিবাদে বাবু ও বিবিদের সব অন্যায় মেনে নিতে হয় যাদের, সেই আমরা সবাই কমবেশি গোলাম বৈকি। সবাই ইয়ে খায়, পাঙ্গাসের নাম। সাংবাদিকদের দোষ দিই বটে, কিন্তু আমরা নিজেরাও কি একেকজন বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বা চেগেভারা? ক্ষমতার ‘ক্ষুদি আরাম’ আনছে আমাদের অনেকেরই জীবনে যা বিচিত্র অন্যায়ের ‘সে গুয়ে ভরা’।
বাংলাদেশে সাংবাদিকদের জীবন ও পেশা কি আদৌ নিরাপদ? একটি সাধারণ রিপোর্ট করার অপরাধে গুম, খুন, কারারুদ্ধ হবার খবর পাই আমরা হরহামেশা। মৌসুমী, শৌখিন লেখক, যা খুশি লিখে আপনি ফেসবুকের চায়ের কাফে ঝড় তুলতে পারেন, কিছুক্ষণ পর বিপদ বুঝলে ‘থুক্কু’ বলে মুছেও দিতে পারেন, কিন্তু একজন সাংবাদিককে হাজার বিপদের কথা ভেবে একটা লাইন লিখতে হয়। সাংবাদিকদের ‘তেলবাজ’, ‘পা-চাটা’ বলে আত্মতৃপ্তি আপনি পেতেই পারেন, আছাড় খেয়ে ব্যথা পাওয়া বাচ্চা যেমন রাগ কমাতে মাটিতে লাথি মারে, কিন্তু আমার প্রশ্ন: প্রথমত, বাংলাদেশের কোন পেশায় তেলবাজি, পা-চাটন নেই? এবং দ্বিতীয়ত, ‘নগরে আগুন লাগিলে দেবালয় কি এড়ায়?’
দৃশ্য-শ্রাব্য-মুদ্রিত মিডিয়ার বিকল্প সামাজিক মিডিয়া আপনার হাতের নাগালে এসে গেছে বেশ কিছু দিন হয়। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করতে পারার জন্য নন্দঘোষ ছাপোষা সাংবাদিকের উপর দোষ না চাপিয়ে নিজেই সাধ্যমতো ঝড় তুলুন না কেন বারোয়ারি চায়ের কাপ ফেসবুকে? ‘তুমিই লিখো না কেন একটি কবিতা!’ নাদান সমালোচকের উপর বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন জীবনানন্দ। (সমাপ্ত)
লেখক: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।