করোনায় শিক্ষার্থীদের আর্তনাদ ও সরকারের করণীয়

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি  © সংগৃহীত

২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে করোনা মহামারির কারণে স্কুল-কলেজসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। প্রায় তেরো মাস ধরে বন্ধ থাকায় শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পড়াশোনা এমন একটা বিষয় যা একটা ফ্লো-এর মধ্যে রাখতে হয়। পড়াশোনার প্রতি একবার অনীহা চলে আসলেই আর পড়তে মন চায় না। পুনরায় পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে অনেকটা সময় লেগে যায়।

একটা প্রবাদ আছে,“শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড”। আর সেই শিক্ষাই যখন অচল হয়ে পড়েছে সুতরাং ভেবে দেখেন জাতি কতটা অচল হবে। আসলেই জাতি অচল হয়ে পড়ছে। এই করোনা মহামারির কারণে স্তব্ধ হয়ে আছে কতো অসহায় বাবা মায়ের স্বপ্ন।অনেক কষ্ট সহ্য করে বাবা-মা তার ছেলে বা মেয়েকে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করেছে কিংবা মেডিকেল অথবা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছে। তাদের স্বপ্ন একটাই সন্তান পড়াশোনা শেষ করে চাকরি পাবে। তখন আর তাদের দুঃখ থাকবেনা। এই সেইম স্বপ্নটা কমপক্ষে ৮০% শিক্ষার্থীর বাবা-মায়ের। কিন্তু বিশ্বের এই মহামারি পরিস্থিতিতে সেই স্বপ্ন পূরণ করাটা দুঃসহ হয়ে গেছে। স্নাতক লেভেল এবং স্নাতকোত্তর লেভেলের শিক্ষার্থীদের জীবনে এই করোনা একটা বড় ধরনের অভিশাপ। এদেশে চাকরি ব্যবস্থা এতটাই নাজেহাল যে একটা পদের জন্য প্রায় ২০০ জন লড়াই করে। এই এত এত প্রতিযোগীর মধ্যেও নিজেকে টিকিয়ে রাখার অনেক স্বপ্ন দেখে। দিনরাত পরিশ্রম করে যেতেই থাকে। আর আজ সেখানে লক্ষ লক্ষ বেকার পড়ে আছে। আমরা সকলেই জানি বিসিএস বা বাংলাদেশ কর্ম কমিশন কর্তৃক যে নিয়োগ দেওয়া হয় তার বয়সসীমা ৩০ বছর পর্যন্ত। কিন্তু এই দেড় বছরের গ্যাপ এর কারণে কত স্টুডেন্টের বয়স শেষ সীমায় পৌঁছে যাচ্ছে কিন্তু এখনো স্নাতক শেষ করতে পারছেনা। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট রয়েছে তাদের অবস্থা তো পাহাড়ের চূড়া থেকে লাফ দেওয়ার মতো।

চাকরির হিসাব বাদ-ই দিলাম। স্নাতক লেভেলে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই সেলফ ডিপেন্ডেড। এই বয়সটাতে প্রতিটা ছাত্রই চেষ্টা করে ফ্যামিলিতে চাপ না দিয়ে নিজেই ইনকাম করে চলতে। কেউ টিউশন করায়, কেউ ছোটখাটো বিজনেস করে আবার কেউ অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিং করে। বিশেষ করে যারা টিউশন করে তাদের খরচ চালাতো, তাদের আজ কি অবস্থা একবার ভাবুন। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় তাদের কপালে মিলছেনা টিউশন। কোন কাজ বা চাকরিও মিলছেনা। কিছু শিক্ষার্থী বিভিন্ন কারণে বাড়ির বাইরে আছে। তাদের চলতে এমন কষ্ট হচ্ছে যে তিনবেলার মধ্যে দু’বেলা খেয়ে বেঁচে আছে। কেননা তাদের সকল ইনকাম সোর্স বন্ধ হয়ে আছে।

এই বয়সে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের বাড়িতে থাকাও একটা অভিশাপ। গতবছর অর্থাৎ ২০২০ সালে অনেকগুলো ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগুলোর জীবনযাপন অবশ্যই আর দশটা গ্রামের মানুষের চেয়ে আলাদা। গ্রামে গিয়ে যেমন তারা খাপ খাওয়াতে পারেনা। ঠিক তেমনি অনেক লাঞ্ছনার শিকারও হয়। ২০২০ সালে নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার এক তরুণীকে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী) গ্রামের একদল বর্বর লোক হামলা করে গুরুতর জখম করে দেয়। একই উপজেলায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থীকে মিথ্যে মামলা দিয়ে ফাঁসানো হয় এবং সেই সাথে তাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে গ্রামের কিছু বর্বর মানুষ। কুমিল্লা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুরসহ বেশ কিছু জায়গায় আমরা এমন অপ্রীতিকর ঘটনা শুনেছি। এসব ঘটনার মূল কারণ হচ্ছে- গ্রামে এমন কিছু মানুষ থাকে ঐ গ্রামের কোন ছেলে-মেয়ে যদি ভালো জায়গায় পড়াশোনা করে তবে তাদের হিংসা হয়। তাদের ভ্রান্ত একটা ধারণার কারণেই এমন আচরণ করে। ভ্রান্ত ধারণাটি হল-একদিন এই ছেলে-মেয়ে এলাকায় শাসন করবে, প্রভাব দেখাবে। আরো কিছু ধারণা যেমন ‘আমার পোলা মাইয়া চান্স পাইনি গরীবের বাচ্চা কেমনে চান্স পাইলো?’ এমন তুচ্ছ কিছু কারণে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগুলোর সাথে ষড়যন্ত্র করতে থাকে।

সরকারের উচিত অন্তত স্নাতক বা স্নাতকোত্তর লেভেলের শিক্ষার্থীদের চলার একটা ব্যবস্থা তৈরি করে দেওয়া। হয় কোন ভাতা প্রদান, কিংবা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেওয়া। কেননা এই শিক্ষার্থীগুলো আগামীতে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করবে। এমন মেধাবী শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে পড়তে দেওয়াটা ঠিক হবেনা। সরকারের আরো একটা বিষয়ের প্রতি নজর রাখা উচিত। করোনা মহামারির কারণে যে সময়টা চলে গেছে তা আর ফিরিয়ে আনতে না পারলেও চাকরিক্ষেত্রে বয়সসীমা দু'বছর বাড়াতে পারবে। এটা না করলে ছাত্রদের সাথে সরকারের অবিচার করা হবে। সরকারের কাছে আরো দাবী যেন কর্মক্ষেত্রে বৃদ্ধি করে সর্বোচ্চ সংখ্যক জনপদ নিয়োগ দেন।

লেখক: শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ