রমজানে করণীয় ও বর্জনীয়
‘হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর’ (সূরা: বাকারা)। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে- ‘রমজান মাস, এমাসে, মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী রূপে কুরআন নাযিল হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসে সিয়াম তথা রোযা পালন করে’ (সূরা: বাকারা)।
সিয়াম সাধনায় সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ পালন করা হয় এবং এর মাধ্যমে সংযমী হওয়া যায়। আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়া অর্জনের সর্বোত্তম পন্থা হলো সিয়াম সাধনা। সিয়াম দ্বারা অতীতের গুনাহসমূহ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। এছাড়া এ মাসেই রয়েছে লাইলাতুল কদর যা হাজার মাস থেকে শ্রেষ্ঠ। যে রাতে মহান মালিক বান্দাদের ভাগ্য লিপিবদ্ধ করেন। আমরা যখন এ মাসের গুরুত্ব অনুভব করলাম তখন আমাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল কীভাবে এ মাসের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগানো যায় সে প্রচেষ্টা চালানো।
রমজান আমাদেরকে সংযমী হওয়ার শিক্ষা দেয়। রোযা পালন সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভের অন্যতম পন্থা। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি হারাম খাদ্য ও পানীয়কে সৃষ্টিকর্তার নির্দেশের কারণে বর্জন করে প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করে। সেই সাথে তারাবীহ, তাহাজ্জুদ, দান-সদকাহ, কুরআন তিলাওয়াতসহ অন্যান্য ইবাদত করার মাধ্যমে তার আত্মার পরিশুদ্ধতা অর্জিত হয়। শুধুমাত্র পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে দিনের বেলায় বিরত থাকাই সংযম নয় বা এটাই সিয়াম সাধনার মূল উদ্দেশ্য নয়। এই পবিত্র মাসকে পূর্ণভাবে সৃষ্টিকর্তার রহমত, বরকত ও নাজাত প্রাপ্তির জন্য আমাদের কিছু করণীয় আছে এবং সেই সাথে কিছু বর্জনীয় রয়েছে যা পরিত্যাগ ও সুন্নাহ অনুযায়ী পালন করতে পারব। প্রকৃতপক্ষে রমজান মাসে সার্বক্ষণিক নিজের কু-প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে প্রকৃত তাকওয়া অর্জন করা সম্ভব। আমাদের ভুলে গেলে হবে না যে, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়টুকু রোজার অন্তর্ভুক্ত নয়; বরং দিন ও রাত্রি উভয় সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে সিয়াম সাধনার প্রকৃত আত্মতৃপ্তি লাভ করা সম্ভব।
পবিত্র রমজান মাসে হাদিসে উল্লেখিত কতিপয় আমল দ্বারা আমরা সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য অর্জন করতে পারি। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন- ‘আল্লাহর রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন- যখন রমজান মাস আসে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। অপর বর্ণনায় রয়েছে- বেহেশতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, দোযখের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয় এবং শয়তানকে শৃংখলিত করা হয়’ (বুখারী ও মুসলিম)।
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, ‘রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কর্ম পরিত্যাগ করেনি, তার পানাহার ছেড়ে দেয়াতে সৃষ্টিকর্তার কোন কাজ নেই’ (বুখারী)। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেন- রমজান মাসের নামাজ কায়েম করার জন্য উৎসাহ দান করতেন; কিন্তু তিনি এ বিষয়ে খুব তাকীদ করতেন না। বরং এরূপ বলতেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের নিয়তে রমজান মাসে নামায কায়েম করবে তার পূর্ববর্তী (সগীরা) গুনাহসমূহ ক্ষমা করা হবে’ (মুসলিম)।
নফল ইবাদতের মধ্যে সর্বোত্তম ইবাদত হলো কুরআন তিলাওয়াত করা। যেমন হযরত নুমান বিন বাশির (রাঃ) হতে বর্ণিত, ‘রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেন- আমার উম্মতের সবচেয়ে উত্তম ইবাদত কুরআন তিলাওয়াত করা (বায়হাকি)। হযরত যায়েদ বিন খালেদ জুহানী (রাঃ) হতে বর্ণিত, ‘রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করালো তাকে রোজাদারের অনুরূপ সওয়াব দান করা হবে। কিন্তু রোজাদারের সওয়াবের কোন কমতি হবে না’ (তিরমিযী)। হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,‘রাসুল (সাঃ) যখন ইফতার করতেন নিচের দোয়াটি পড়তেন- হে সৃষ্টিকর্তা! আমি তোমার জন্য রোজা রেখেছি এবং তোমার রিজিক দিয়ে ইফতার করছি। তুমি আমার এই রোজাকে কবুল কর। নিশ্চয় তুমি সর্বজ্ঞ, সর্বশ্রোতা’ (তাবারনী)। হযরত সালমান আমের (রাঃ) বলেন, ‘রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন- যখন তোমাদের কেউ ইফতার করে সে যেন খেজুর দ্বারা ইফতার করে, কেননা এতে বরকত রয়েছে। যদি খেজুর না পায়, তবে যেন পানি দ্বারা ইফতার করে, এটি পবিত্রকারী’ (আহমদ,তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, দারেমী)।
এই রমজান মাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত্রি হলো লাইলাতুল কদর। হাদিস মোতাবেক রমজানের শেষ দশদিনের বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করার কথা বলা হয়েছে। এই জন্য যে মহান সৃষ্টিকর্তা দেখতে চান, লাইলাতুল কদরের বরকত ও ফজিলত লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর কোন বান্দা বেশি ইবাদত করে। রাসুল (সাঃ) এই শেষ দশকে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন তা নিম্নোক্ত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রাসুল (সাঃ)-কে লাইলাতুল কদরের কথা জিজ্ঞাসা করলাম, আজ কি দোয়া পাঠ করব? তখন রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করে বললেন- এই দোয়াটি পাঠ করবে- হে মহান সৃষ্টিকর্তা! নিশ্চয়ই তুমি ক্ষমাশীল। তুমি ক্ষমাশীলতাকে ভালোবাস। অতএব আমাকে ক্ষমা করো’ (তিরমিযী, মুসনাদে আহমদ)।
রমজানের শেষের দশ দিনে এতেকাফ করা সুন্নত। পুরুষরা মসজিদে এবং স্ত্রীলোকেরা আপন ঘরে একটি স্থান ঘিরে নিয়ে তথায় এতেকাফ করবে। হাদিসে এসেছে- হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, রাসুল (সাঃ) রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করতেন, যাবৎ না মহান সৃষ্টিকর্তা তাকে উঠিয়ে নিয়েছেন এবং তাঁর স্ত্রীগণও এতেকাফ করেছেন (বুখারী ও মুসলিম)।
ইসলামি শরিয়াত সকল কাজে সম্পাদনের পদ্ধতি নির্ধারিত করে রেখেছে। তদুপরি আমরা অজ্ঞতা বসত অনেক বিষয় বাড়তি ও কমতি করে থাকি। রোযা পালনের ক্ষেত্রে কোনো মোস্তাহাব কাজকে মাকরূহ আর মাকরূহকে মোস্তাহাব হিসেবে গণ্য করি অনেকে।
রমজান মাসের কতিপয় মোস্তাহাব কাজসমূহ
১) সময়মত সাহরী খাওয়া। সাহরী রাত্রের শেষ ভাগে খাওয়া। ২) সূর্যাস্তের পর বিলম্ব না করে ইফতার করা। ৩) রাতে বড় নাপাকি হলে ফজরের পূর্বেই গোসল করে পাক হওয়া। ৪) গীবত, পরনিন্দা ও গালি-গালাজ থেকে জিহ্বাকে সংযত রাখা। ৫) রমজানের সুবর্ণ সুযোগকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো, অর্থাৎ কুরআন তেলাওয়াত, যিকির ও বেশি বেশি দুরূদ শরীফ পাঠসহ ইত্যাদিতে লিপ্ত থাকা, উত্তেজিত না হওয়া।
যেসব কারণে রোযা মাকরূহ হয়
১) বিনা কারণে চিবিয়ে লবণ বা কোন বস্তুর ঘ্রাণ গ্রহণ করা। ). গোসল ফরজ অবস্থায় সরাসরি গোসল না করে থাকা। ৩) শরীরের কোথাও শিঙ্গা ব্যবহার করা বা রক্তপাত করানো। ). পরনিন্দা করা। ৫) ঝগড়া করা। ৬) রোযাদার নারী ঠোটে রঙ্গিন জাতীয় কোন বস্তু লাগানো যা মুখের ভেতর চলে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। ৭) রোযা অবস্থায় দাঁত উঠানো বা দাঁতে ঔষধ ব্যবহার করা, তবে একান্ত প্রয়োজনে তা জায়েজ।
যে সকল কারণে রোযা ভাঙ্গে না এবং মাকরূহ হয় না
১) মেসওয়াক করা। ২) শরীর, মাথা, দাড়ি এবং গোঁফে তেল লাগানো। ৩) চোখে সুরমা বা ঔষধ লাগানো। ৪) খুশবু লাগানো বা তার ঘ্রাণ নেয়া। ৫) ভুলে কিছু পান করা, আহার করা। ৬) অনিচ্ছাবশত: গলার মধ্যে ধোঁয়া, ধুলা-বালি-মাছি ইত্যাদি প্রবেশ করা। ৭) কানে পানি দেয়া বা অনিচ্ছাবশত চলে যাওয়ার কারণে রোযা ভঙ্গ হয় না। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে দিলে সতর্কতা হলো সে রোযাটি কাযা করে নেয়া। ৮) অনিচ্ছাকৃত বমি করা। ৯) স্বপ্নদোষ হওয়া। ১০) মুখে থুথু আসলে গিলে ফেলা। ১১) ইনজেকশন বা টিকা নেয়া। ১২. দাঁত উঠালে এবং রক্ত পেটে না গেলে। ১৩) সাপ ইত্যাদি দংশন করলে। ১৪) পান খাওয়ার পর ভালভাবে কুলি করা সত্ত্বেও থুথুর সাথে লালভাব থাকলে।
যে সকল কারণে রোযা ভেঙ্গে যায় এবং কাযা-কাফফারা উভয় ওয়াজিব হয়
১) রোযা রেখে ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করলে। ২) ইচ্ছাকৃত স্ত্রী সহবাস করলে। এতে স্বামী স্ত্রী উভয়ের উপর কাযা ও কাফফারা ওয়াজিব হবে। ৩) রোযা অবস্থায় কোন বৈধ কাজ করলে, যেমন স্ত্রীকে চুম্বন করল কিংবা মাথায় তেল দিলে, তা সত্ত্বেও সে মনে করলো যে, রোযা নষ্ট হয়ে গিয়াছে; আর তাই পরে ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার ইত্যাদি করলো, তাহলে কাযা কাফফারা ওয়াজিব হবে।
সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির জন্য ইবাদত ও সৎকর্মের মাধ্যমে এই রমজানের ফজিলত আমরা পূর্ণভাবে অর্জন করতে পারি। এই মহান মাসে আমাদের উপর রহমত, বরকত ও মাগফেরাত অর্জনের মাধ্যমে আমরা যেন সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভ করতে সক্ষম হই। আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও ম্যানেজার (মুদ্রণ বিভাগ), দৈনিক সিলেটের ডাক