বিকৃত মানসিকতা বিপদের

সজীব ওয়াফি
সজীব ওয়াফি  © টিডিসি ফটো

আমাদের বাঙালি শিল্প সংস্কৃতি হাজার বছরের পুরোনো। নানান সময়ে শাসকদের পরিবর্তন বিবর্তনে বর্তমান সময়ে এসে ঠেকেছে। বাংলাদেশে আমরা যতটা না এই সংস্কৃতি ধরে রাখতে পেরেছে, শিল্প সংস্কৃতি রক্ষায় তার চেয়ে বেশি সচেতন পশ্চিমবঙ্গের মানুষজন। আমরা ক্রমে ক্রমে হাঁটছি আমাদের সংস্কৃতি বিপর্যয়ের দিকে।

পশ্চিমা প্রভাবে সব সময়ে আমরা মনে করি তারা সভ্য সমাজের। ব্রিটিশ শাসনের বিভিন্ন সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশ এবং বাঙালিদের অসভ্য আখ্যায়িত করে তুচ্ছতাচ্ছিল্যও করেছে তারা। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে তাদের সভ্যতার খোলস বেরিয়ে এসেছে।

সর্বশেষ মার্কিন নির্বাচনের পর ক্যাপিটাল হিলে কংগ্রেসের উপর ন্যাক্কারজনক আক্রমণ যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি অবহেলা করে পড়াশুনা, খাদ্য, পোষাক সবক্ষেত্রেই এই নামেমাত্র ভদ্র সমাজকে অনুসরণ করছি!

একের পর এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল দাঁড়াচ্ছে। অবিভাকেরাও ঝুঁকে পড়েছে বাছ-বিচারহীনভাবে। পশ্চিমা কায়দার এই স্কুলগুলোতে বাংলার কোন বালাই নাই। সেখানে বাচ্চাদের না শেখানো হয় বাংলা বর্ণগুলো, শেখানো হয় না নিজের মাতৃভাষাটাও।

এমনকি রক্তদিয়ে কেনা রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীতটা গাইতেও অবহেলা তাদের। এসব বাচ্চারা পরবর্তীতে বাংলা লিখতে বলতে পড়তে মারাত্মক অসুবিধার সম্মুখীন হন। অথচ ভাষার দাবিতে রক্ত দিয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে আর একটাও নাই।

ভাষার মাস আসলেই কেবল তোড়জোড় দেখা যায়। সংস্কৃতি যেন একদিন কেন্দ্রীক হয়ে গেছে। বাকী দিনগুলোতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও তাঁর ছাত্রদের উপর বাধ্যতামূলকভাবে চাপিয়ে দেন ইংরেজি। বাউলের একতারার সুর হারিয়ে গেছে সেই কবে। গ্রামের মেঠোপথে ধুতি-পাঞ্জাবি পড়ুয়া মানুষ যেন এখন আর মেলে না।

হিন্দু-মুসলমানসহ বিভিন্ন মতের মানুষের অসাম্প্রদায়িক চেতনার আবাস আমাদের পবিত্র ভূমি। তাঁতি, কুলি, মজুর, কৃষক-শ্রমিক যেমন আছে, তেমন আছে মধ্যবিত্ত। একে অপরের গায়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে যাদের নিত্যদিনের চালচলন। অন্যদিকে বর্তমান শতাব্দীতে আমরা এমন একটা দুঃসময়ের দিকে আগাচ্ছি যেখানে প্রতিহিংসা আক্রমণ করেছে ক্রমাগত।

নিজেদের অপছন্দের কেউ বিপদগ্রস্ত হলে বা মারা গেলে উল্লাসে ফেটে পড়ছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবরের মন্তব্য ঘরে চোখ রাখলে চরম নেতিবাচক মন্তব্য দেখতে দেখতে হতাশ হয়ে ফিরতে হচ্ছে। বহু শতাব্দী ধরে চলে আসা আমাদের আচরণ কি এমন ছিলো? এটা কি আমাদের সংস্কৃতি? আমাদের সংস্কৃতি তো ছিলো সুস্থ, সহানুভূতির এবং সম্মানের।

দিনেদিনে ভিন্নমত সহ্যশক্তি যেন কমে এসেছে। একেবারেই তলানিতে ঠেকেছে সৌজন্যতাবোধ। একতরফাভাবে কখনো অন্ধকারের ভেতর আক্রমণ হচ্ছে মন্দির, মঙ্গল শোভাযাত্রা সম্পর্কে আসছে নেতিবাচক বয়ান।

নাস্তিক-আস্তিক সার্টিফিকেট প্রদান করতে যেন নির্দিষ্ট একটা গোষ্ঠীকে সৃষ্টিকর্তা পাঠিয়েছেন। অন্যধর্মের মানুষকে আখ্যায়িত হচ্ছে বিধর্মী বলে। যেখানে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা সব মানুষকে সমান চোখে দেখছেন, সবাইকে খাওয়াচ্ছেন।

বিকৃত মানসিকতা ফেরাতে পত্রপত্রিকা গুলোকেই সচেতনতামূলক দায়িত্ব নিতে হবে। সকলে মিলে পুনরাবৃত্তি করতে হবে শিল্প সংস্কৃতি চর্চার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ফিরতে হবে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলার দিকে। স্কুলগুলোতে উৎসাহ দিতে হবে পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই পড়তেও। ইংলিশ মাধ্যমের স্কুলগুলোতে করতে হবে বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার সুষ্ঠু নীতিমালা। পারিবারিক নৈতিক শিক্ষার সাথে সাথে তৈরি করতে হবে সহানুভূতির আচরণ।

পশ্চিমাদের ব্যাট আর বলে হারিয়ে গেল আমাদের দাড়িয়াবান্ধা খেলা। লাঠিখেলা, নৌকা বাইচ এখন শুধুমাত্র বইয়ের ভাষা। সভ্যতার যাতাকলে হারিয়ে গেল আমাদের গ্রাম বাংলার সোনালী কৈশোর, মানুষে মানুষে সহানুভূতি, সম্প্রতি। এ বিপর্যয় আটকানো না গেলে আমাদের যাত্রা গন্তব্যহীনই না। বরঞ্চ সভ্যতার সংকট অনিবার্য।

লেখক: রাজনৈতিক কর্মী ও বিশ্লেষক


সর্বশেষ সংবাদ