প্রসঙ্গ ভিক্টিম ব্লেইমিং
ছোটবেলায় একটা ছড়া লিখেছিলাম। মসজিদ থেকে জুতা চুরি নিয়ে। খেয়াল করে দেখলাম, ছড়াটিতেও ভিক্টিম ব্লেমিং রয়েছে। জুতা চুরি হওয়ার জন্য লোকজন আমাকেই দোষ দিচ্ছেন। তাদের ভাষ্য জুতা আমার কাছ থেকে অতদূরে কেন রাখতে গেলাম। ছাড়ায় এটা এমনিতে আসেনি। খেয়াল করে দেখবেন। কোন বিপদে পড়ছেন। কারো সাথে শেয়ার করতে যাবেন। দেখবেন সে সহানুভূতি বা সমানুভূতির বদলে আপনাকেই দোষ দিচ্ছে। একটা মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে তো কথাই নেই। কেউ সরাসরি, কেউ ইনিয়ে বিনিয়ে আবার কেউ ভাববাচ্যে মেয়ে ভিক্টিমের দোষ দেয়। আমরা যারা নিজেদের শিক্ষিত বলি; তারা প্রকাশ্যে দিতে পারিনা বলে মনে মনে দেই।
মেয়েদের দোষ কেন দেয়া হয়- আমি এর কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছি। বিষয়টি আইনি পরিমন্ডলে বিশ্লেষণ করেছি। দেখলাম আমাদের আইনি কাঠামো এই ভিক্টিম ব্লেমিংয়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছে। বিষয়টা আমি খুঁজে পেয়েছি বিদেশে বান্ধবিদের সাথে মজা করতে গিয়ে। ঘটনাটা বলি।
একদিন আমি বেশ কয়েকজন বিদেশী সহপাঠিনীর সাথে আড্ডায় ব্যস্ত। তারা নিজেদের দেশের নারী কেন্দ্রিক পিকিউলিয়ার সংস্কার বা প্রথার কথা বলছে। সবশেষে আমার পালা। আমি বললাম, আমাদের দেশে নারী কেন্দ্রীক অনেক কৌতুহলপ্রদ ও ভাবনার খোড়াক কিছু আইন আছে। যদিও বাংলাদেশে নারীরাই সেই নব্বইয়ের দশকের পর থেকে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেত্রী, স্পীকারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন। তারপরেও নারী সম্পর্কিত আইনগুলো শুনলে তোমরা পুলকিত হবে।
১। মজার বিষয় হলো বাংলাদেশে এখনো আদালত থেকে কোন নোটিশ বা সমন নারীরা গ্রহণ করতে পারেনা। ধরো, কারো নামে আদালতে কোন অভিযোগ হলো। অথবা আদালত কাউকে ডেকেছেন। সেই নোটিশ নিয়ে প্রসেস সার্ভার ওই ব্যক্তির বাড়িতে উপস্থিত হলেন। গিয়ে দেখেলন, ওই ব্যক্তি নেই। তবে ঘরে তার স্ত্রী, বোন, মা, মেয়ে আর অপ্রাপ্ত বয়স্ক পুত্র রয়েছে। সিআরপিসির ৭০-ধারা অনুযায়ী প্রসেস সার্ভার তাদের কারো কাছেই ওই নোটিশ হস্তান্তর করতে পারবেন না।
তখন তিনি আশপাশের মানুষকে ডাকবেন। তারপর তার ঘরের দড়জায় নোটিশটি লটকিয়ে জারি করবেন। আমি একবার একটা ঘটনা অনুসন্ধান করে দেখেছি। আমার জেনারেল সার্টিফিকেট কোর্টে এক ব্যক্তির নামে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ একটা মামলা দয়ের করে। ওই ব্যক্তি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেনি। আমি মামলা আমলে নিয়ে ওই ব্যক্তিকে কোর্টে হাজির হতে সমন দেই। সেই নোটিশ নিয়ে প্রসেস সার্ভার তার বাড়িতে যান। পরে দেখতে পাই ঘরের দরজয় নোটিশ লাগিয়ে জারি করা হয়েছে মর্মে প্রসেস সার্ভার রিপোর্ট দিয়েছেন।
খবর নিয়ে জানলাম, ওই ব্যক্তির স্ত্রী ঘরে ছিলেন। তিনি একটা কলেজের অধ্যাপক। আইন তাকে নারী হিসেবেই বিবেচনা করেছে। তার হাতে জারি করা যায়নি। আমার গল্প শুনে বান্ধবিদের আগ্রহ বেড়ে গেলো। বললাম আরো শুনবা? তারা বলে, ইন্টারেস্টিং। আমি বলি কেবল তো শুরু। আরো শুনো তাহলে।
২। আমাদের একটা পেনাল কোড রয়েছে। তার ৪৯৭ ধারায় পরকীয়ার শাস্তির কথা বলা হয়েছে। কোন ব্যক্তি যদি অপর কোন ব্যক্তির সম্মতি বা তাকে কনভিন্স না করে তার স্ত্রীর সাথে পরকীয়া করে তবে পরিকীয়ায় লিপ্ত ব্যক্তির সবোর্চ্চ পাঁচ বছরের কারাদন্ড ও যেকোন পরিমাণের জরিমানা বা উভয় দন্ড দেয়া হবে। এক্ষেত্রে মহিলার কোন সাজা হবেনা। পরকীয়া করলেও তাকে অ্যাবেটর বা সহায়তাকারি হিসেবেও ধরা যাবেনা। মোট কথা মহিলা নির্দোষ।
এতে মনে হচ্ছে, স্বামী কনভিন্সড হলে পরকীয়ার কোন সাজাই নেই। আইনের এমন প্রবিধান শুনে ওরা হাসতে হাসতে শেষ। বলে এটা তো দারুন ব্যাপার। মেয়েরা এনজয় করলে তার শাস্তি নেই। আমি বললাম, তোমরা যে পারসপেকটিভে বিষয়টা দেখছো আমাদের আইনে আসলে তা নয়। মেয়েদের সেক্সুয়াল আর্জ যে আছে সে যে কোন পুরুষকে প্রলুব্ধ করে তার কাছে যেতে পারে, এনজয় করতে পারে এটা আইন স্বীকার করেনা। তাহলে শুনো আরেকটা আইনের প্রবিধান বলি।
৩। আমাদের দেশের যে ধর্ষণের পরিসংখ্যান দেখতে পেয়েছো, এটা আসলে বাস্তবতার প্রতিফলন নয়। কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, জোর করে বা বলপূর্বক ধর্ষণের ঘটনা অনেক কম। বেশিরভাগ অসফল প্রেমের পরিণতিতে এসব মামলার উদ্ভব হয়েছে। তারা জিজ্ঞাসা করে, এটা কীভাবে? আমি তাদের বুঝিয়ে বলি, ধরো, কোন ছেলে মেয়ে প্রেম করছে।
আগে সমাজে প্রেমের স্বীকৃতি ছিলনা। এখন স্বীকৃতি মিললেও প্রেমই ঠুনকো হয়ে গেছে। বেশি দিন টেকেনা। কিন্তু প্রেম চলাকালীন তারা দুজনের সম্মতিতেই শারিরীক সম্পর্কে জড়িত হয়েছে। এবার ছেলেটি মেয়েটাকে ছেড়ে গেলো বা প্রেম ভেঙ্গে গেলো। মেয়েটা প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ছেলেটার নামে ধর্ষণের মামলা করে দিতে পারবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ৯(১) ধারা অনুযায়ী কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ষোল বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবেন।
এই আইনের আলোকে মেয়েরা বিয়ের প্রলোভন দিয়ে ধর্ষণ করেছে মর্মে আদালতে নালিশ করতে পারেন। এখানে শারিরীক সম্পর্ক তিনি এনজয় করেছেন মর্মে আমাদের আইনে স্বীকৃতি নেই। থাকলে নিশ্চিয়ই শুধু ছেলেটার নামে মামলা দায়ের হতোনা। বাংলাদেশের আইন মেয়েদের পক্ষে বলে তাদের খুশী মনে হলো। বললাম, বাংলাদেশে জন্ম না হয়ে তোমাদের একটা সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেলো। নয়তো কয়টা ছেলে যে জেল খাটতো তার কী কোন ঠিক ঠিকানা আছে! আমার বিদেশি বান্ধবিরা বলে, সেক্সুয়াল বিষয় নিয়ে তো তোমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স। আমি বললাম, তা বৈ কী! তাহলে উচ্চ আদালতের আরেকটা নির্দেশনা শুনো।
৪। কিছু দিন আগে নারীদের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন বেড়ে যায়। এটা রোধ করার জন্য ২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট একটি রায় দেন। রায়ে উচ্চ আদালত সাত দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। তার মধ্যে একটি হলো- কোন ছেলে একজন নারীকে দেখে বললো তুমি অনেক সুন্দরি। এটাও ইভটিজিং হবে। এর শাস্তি হিসেবে আমরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে পেনাল কোডের ৫০৯ ধারায় তাকে যেকোন টাকার জরিমানাসহ এক বছরের কারাদন্ড দিতে পারি।
এটা শুনে আমার ইন্দোনেশিয়ান ক্লাসমেট আতা বললো, আমি যদি বলি; সায়েম, তুমি অনেক সুন্দর? তাহলে এটাও কী ইভটিজিং হবে। আমি বললাম, না। মেয়েরা কোন অপরিচিত ছেলেকে সুন্দর কেন অন্য কিছু বললেও আপতদৃষ্টিতে মেয়েটার কোন কোন অপরাধ হবেনা। আসলে আমাদের কথা হচ্ছিল নারী নির্যতনের বৈশ্বিক চিত্র এবং কোরিয়ান আইন বিষয়ক একটি কর্মশালার বিরতিতে। কিছুক্ষণ আগেই বিভিন্ন দেশে ধর্ষণের একটা চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। তালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয়। এটা একটা মেয়ে মনে রেখেছে।
সে বললো, তোমার কথায় বুঝলাম, তোমাদের দেশে মেয়েদের রক্ষায় অনেক আইন কানুন রয়েছে। তারপরেও এত ধর্ষণ কেন। আমি বললাম, আমাদের সমাজ কনজজারভেটিভ। ছেলেমেয়েরা বিয়ে বহির্ভূত শারিরীক সম্পর্কে যাতে না জড়ায় সেকারণেই এসকল আইনের উদ্ভব। তবে এসব আইন দেখে মনে হবে- আদালতে বুঝি খুব সহজেই মেয়েরা ধর্ষণের প্রতিকার পেয়ে থাকে। বাস্তবতা ভিন্ন। তাহলে শুনো আরেকটা আইনের প্রবিধান।
৫। বললাম, ধরো- একটা মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে আদালতে প্রতিকার চাইতে গিয়ে মামলা করেছেন। সেখানে গিয়ে তিনি ধর্ষকের তরফ থেকে প্রথম যে ধাক্কাটা খান সেটা হলো- তার চরিত্র খারাপ এটা আসামী পক্ষ প্রমাণ করতে চায়। আমিও সাংবাদিকতাকালে ধর্ষণের জেরা শুনতে আদালতে গিয়ে বসে থাকতাম। সেখানে নিচু স্বরে ‘ভাড়াইট্টা’ ‘নষ্টা’ কত শব্দ যে শুনতাম।
পতিতা প্রমাণ করতে পারলেই তাদের খালাস কে ঠোকায়। এর আবার আইনী ভিত্তি রয়েছে। আমাদের দেশে আরেকটা প্রাচীন আইন আছে। এটা ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইন। এই আইনের ১৫৫ ধারায় ধর্ষণের জেরা চলাকালে নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে। এবার বুঝো ধর্ষণের প্রতিকার চাইতে গিয়ে চরিত্র হারিয়ে নতুবা প্রশ্নবোধক চিহ্নে জর্জরিত হয়ে আসতে হয়।
এ নিয়ে ভারতের একজন বাংলাভাষী লেখিকা সুচিত্রা ভট্রাচার্য ‘দহন’ নামের একটা উপন্যাসও লিখেছেন। যেটা ২০১৮ সালে চলচ্চিত্র হিসেবে মুক্তি পেয়েছে। এই সিনেমাটা দেখতে পারো। আমার কথা শুনে আমার বিদেশি সহপাঠিনীদের এতক্ষণের আনন্দ মিইয়ে গেছে। সবার মুখ থমথমে। এরমধ্যেই আমাদের সুপারভাইজার তাড়া দিলেন আমাদের বিরতির সময় শেষ। ভাগ্যটা ভালো সহপাঠিনী বিদেশী মেয়েদের সাথে আড্ডাটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। হলে হয়ত আমার কাছ থেকে আরো অনেক কিছু বের হতো। বাংলাদেশের আইন একজন নারীকে কী দৃষ্টিতে দেখে তার আরো কিছু জানা যেতো।
যাই হোক উপসংহার টানি। আইন নিয়ে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আমার নেই। এত যোগ্যতাও আমার নেই। করতেও চাইনা। তবে জুরিসপ্রুডেন্স পড়েছি। কোন দেশের আইন তার সমাজ ব্যবস্থার প্রতিফলন বটে। মানুষের চিন্তা চেতনার প্রতিফলন। কোন একটা ধর্ষণ হওয়ার পর ফেসবুকের কমেন্ট সেকশনে গেলেই দেখা যায়- মেয়েটার পোশাক এমন ছিল কেন, মেয়েটা ওখানে যেতে গেলো কেন- কত কী প্রশ্ন। এক কথায় ভিক্টিম ব্লেইমিং।
এটা কী সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ ধারার প্রতিফলন কী না জানিনা! এই বিংশ শতাব্দীতেও বাংলাদেশের নারীরা আদালতের নোটিশ গ্রহণ করার অধিকার রাখনেনা- এটা নিয়ে কোন নারীবাদিকে কথাও বলতে শুনিনা। মানে সমাজ মেনে নিয়েছে। মানে কোন মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলেই সমাজ মেয়েটাকেই প্রশ্ন করে। তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করে। এটাই তো সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ ধারার ভিত্তি বলে মনে হয়! সাক্ষ্য আইন বাংলাদেশের মতো ভারত পাকিস্তানেও প্রচলিত ও কার্যকর।
তবে ২০০০ সালে বিচারপতি বি.পি. জীবন রেড্ডির নেতৃত্বাধীন আইন কমিশনের সুপারিশক্রমে ভারত সরকার ২০০৩ সালে এই ধারা বাতিল করেছে। বলছিলাম, কোন কথা বলবোনা। তবে একটা কথা না বলেও পারছিনা- নারী সম্পর্কিত উপরের যেসব আইন বা ধারা উল্লেখ করলাম- তা যুগের চাহিদায় রেশনালাইজ করা যেতে পারে। এটা করলে নারী কেন্দ্রিক যে দৃষ্টিভঙ্গি তা হয়ত পাল্টাতে পারে
লেখক: শিক্ষার্থী, কিউং হি ইউনিভার্সিটি, দক্ষিণ কোরিয়া