মৌলির চলে যাওয়ার একবছর: যোগ্যতাই ছিলো ছাত্রলীগে ওর বড় অযোগ্যতা

ছাত্রলীগ নেত্রী ফারমিন আক্তার মৌলির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মৃতিচারণ
ছাত্রলীগ নেত্রী ফারমিন আক্তার মৌলির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মৃতিচারণ  © টিডিসি ফটো

ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন কমিটির মাঝামাঝি সময়ে একদিন সন্ধ্যার দিকে হাকিম চত্বরের রাজনৈতিক আড্ডাস্থলের একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর চিন্ময়। একটা মেয়ে এগিয়ে এলো আমাদের দিকে। চিন্ময় আমাকে বললো ওকে চিনিস? আমি বললাম মহানগর দক্ষিণের ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক, আমাদের এলাকার মেয়ে কিন্তু আমার সাথে পরিচয় নেই। এর মধ্যে মেয়েটি আমাদের কাছে চলে এসে আমাকেই সালাম দিয়ে হাসিমুখে বললো ভাই আমি আপনার এলাকার মেয়ে।

চিন্ময় কথা কেড়ে নিয়ে মজা করে বলল কি অবস্থা ‘বরিশাইল্লা’ এলাকার ভাই পেলে আর কাউকে চিননা। মেয়েটি বললো দাদা আপনিতো আমাকে চিনেন কিন্তু ভাই এলাকার হয়েও আমাকে চিনেনা। আমি বললাম আমি আপনাকে চিনি কিন্তু কথা হয়নি কখনো। মেয়েটি বললো ভাই আমি আপনার ছোটবোন আমাকে তুই করে বলেন।

সেদিনের পর থেকে নিয়মিত দেখা হতো মৌলির সাথে। সপ্তাহে অন্তত ২-৩ দিন ফোন দিয়ে বলতো ‘ও ভাই’ আপনি কই, আপনি থাকলে ইউনিভার্সিটি আসবো। সপ্তাহে কম করে হলেও ১ দিন দেখা হতো ওর সাথে, যতক্ষণ থাকতো ৯০% সময় রাজনীতি বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ চাওয়া ছিলো ওর রুটিন কাজ। মাঝেমধ্যে আমি বিরক্ত হতাম কারণ একটা মেয়ে মানুষ এতোটা রাজনীতি পাগল হোক এটা আমি চাইতাম না।

মাঝে মাঝে ধমক দিতাম। আমার নেতা সাজ্জাদ সাকিব বাদশা ভাইয়ের পরিবারের যেকোনো বিশেষ দিনে আমাকে একপ্রকার ধরে নিয়ে যেতো ভাইয়ের বাসায়। সপ্তাহে অন্তত একবার বলতো ও ভাই চলেন ভাইর সাথে একটু দেখা করে আসি। টিএসসিতে যেদিন আসতো সারাক্ষণ পাশে পাশে ঘুরে বেড়াতো আর বলতো ও ভাই একটু কথা আছে।

দেশের যেকোনো খারাপ পরিস্থিতিতে ফোন করে দাবি নিয়ে বলতো ও ভাই আপনি একটু সাবধানে থাইকেন, একা বের হইয়েন না, রাতে বাইরে থাইকেন না, আপনার অনেক শত্রু। এরকম অনেক স্মৃতি আছে ওর সাথে। এরপরে এলো ২৯তম সম্মেলন, মন দিয়ে চেয়েছে আমি কিছু একটা হই। সাধ্যমতো অনেক জায়গায় লবিংও করেছে। শেষমেশ কমিটি হলো। শোভন-রাব্বানী কমিটি। আবার বললো ও ভাই কি করবো বলেন। অনেক হিসেব নিকেশ করে সিদ্ধান্ত নিল রাব্বানী ব্লকে যাওয়ার। অনেক বলেছি রাজনীতির বাইরেও একটা দুনিয়া আছে, সেটাকেও গুরুত্ব দাও। কারণ ও যতই রাজনীতি নিয়ে ভাবুক আমার কখনোই মনে হয়নি ও বর্তমান রাজনীতির জন্য যোগ্য।

আসলে ওর যোগ্যতাই ছিলো সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা। রক্তে আওয়ামিলীগ, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সন্তান, মার্জিত আচরণ, সকল প্রোগ্রামে উপস্থিতি ও সকল পর্যায়ের নেতাদের সাথে যোগাযোগ থাকার পরেও মৌলিকে আমি রাজনীতিতে নিরুৎসাহিত করেছি। এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে আমি ওকে বলেছিলাম নিজেকে বিকিয়ে দিতে না পারলে এই সময়ে তুমি রাজনীতি করতে পারবেনা। মৌলি বলেছিল ভাই আমার রক্তে আওয়ামিলীগ, আমার ফ্যামিলির সবাই রাজনীতি করে, আমার একটা ভাই নেই তাই আমি বংশের ধারক হিসেবে পরিচ্ছন্নতার সাথে এগিয়ে যেতে চাই এবং আপনারা পাশে থাকলে আমি পারবো। বলেছিলাম চেষ্টা কারো পাশে আছি।

ফাইনাললি মৌলিকে ছাত্রলীগে একটা সদস্য পদও দেয়া হয়নি। রাজনীতিতে মৌলী এই সময়ের অনেকের চেয়ে বয়সে জুনিয়র হলেও কর্মে অনেকগুণে এগিয়ে ছিলো তবুও ও—যে এই সময়ের রাজনীতিতে অযোগ্য এটা ও নিজেও বুঝতো। ছাত্রলীগ কমিটিতে না রাখায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ মৌলিকে পিরোজপুর জেলা শাখার সভাপতি করেছিল। একদিকে বাড়িতে মা অসুস্থ অন্যদিকে কমিটিতে জায়গা না পাওয়ায় কিছুটা ডিপ্রেশন ছিল শেষ দিকে আমি বুঝতে পারতাম। আমি বোঝাতামও যথাসাধ্য।

নির্বাচনের সময় থেকে কিছুদিন পরপর বাড়িতে যেতো। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পরে শাওন ফোন দিয়ে বললো ভাই শুনলাম মৌলি নাকি বাড়ি যাবার পথে এক্সিডেন্ট করেছে, মনে হয় নেই ও, আপনি একটু খবর নেন। আমার মনে হচ্ছিল মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। কিছুক্ষণ পরে নিশ্চিত হলাম আসলেই নেই ও। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। সারারাত ঘুম আসেনি। এখনো আমার বিশ্বাস হয়না ও নেই। ওকে শেষ দেখা দেখতে যাবার সাহস আমার হয়নি। কয়েকদিন টিএসসি গিয়ে বসে থাকতাম যেখানে ও আমার সাথে দেখা করতে আসতো। এখনো আমার কানে বাজে ওর “ও ভাই” ডাক। আমি মিস করি। এইভাবে আমাকে কেউ ডাকেনা। করোনাকালে খুব মিস করেছি ওর খেয়ালী ফোন। কেউ ফোন দিয়ে বলেনি ও ভাই আপনি সাবধানে থাইকেন। ওর সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক হয়তো ছিলনা কিন্তু আত্মার সম্পর্ক ছিলো। ও চলে গিয়ে আমাকে বোনহারা করেছে।

২২ সেপ্টেম্বর ওর জন্মদিন ছিলো। গতবছর এই দিনে সন্ধ্যার একটু পরে টিএসসি এসে আমাকে বললো ও ভাই একটু আসেন কথা আছে। কথা বলতে বলতে আমাকে নিয়ে পরমাণু শক্তি কমিশনের গেটে গেলো, দেখি সে কেক নিয়ে এসেছে আমাদের সাথে কাটবে বলে। কেক কাটলাম, খেলাম পরে বিদায় নিল। এবার জন্মদিনে ও আসেনি কেকও কাটা হয়নি আর হবেওনা কোনোদিন। শুধু মন ভরে দোয়া করি আল্লাহ যেনো বেহেশতে ওর সব চাওয়া পূরণ করে।

সবশেষে মৌলির কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী, ভাই হিসেবে হয়তো পুরোপুরি দায়িত্ব আমি পালন করতে পারিনি যে কারণে ওকে অসময়ে চলে যেতে হয়েছে।

প্রসঙ্গত, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) ছাত্রলীগের ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন ফারমিন আক্তার মৌলি। গত বছরের এই দিনে (১০ ডিসেম্বর) ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া হয়ে নিজ বাড়ি পিরোজপুরের নাজিরপুরে ফেরার পথে দুর্ঘটনা প্রাণ কেড়ে নেয় মৌলির। তিনি পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নাজিরপুর সদর ইউপি চেয়ারম্যান মোশারেফ হোসেন খানের মেয়ে। ঢাকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথের শিক্ষার্থী তিনি।

লেখক: সাবেক সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।


সর্বশেষ সংবাদ